বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির হোতা ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। ৮ বছর তদন্তের পর আকস্মিকভাবে একযোগে তাকে ৫৮ মামলায় আসামি করা হয়েছে। কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী এ ব্যাংকখেকোকে গ্রেফতারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো তৎপরতা নেই। নীরব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। তবে তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। বিদেশ গমন ঠেকাতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাছেও পাঠানো হয়েছে চিঠি। এতকিছুর পরও তাকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না-তা নিয়ে অপার রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে-এমন প্রশ্নে চলছে ঠেলাঠেলি।
এদিকে, বাচ্চু বর্তমানে দেশে নাকি-বিদেশে অবস্থান করছেন তা নিয়েও জনমনে আছে ধোঁয়াশা। কেউ কেউ তার দেশত্যাগের কথা বলছেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের একাধিক সূত্র জোর দিয়ে বলেছে, দেশেই আছেন তিনি। তার অবস্থান এখন ঢাকার একটি বিশেষ এলাকায়। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে যে কোনো দিন তাকে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হতে পারে। তাকে গ্রেফতার না করতে উপর মহলের কোনো চাপ নেই বলেও সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে, শুরু থেকেই বাচ্চুর ব্যাপারে রহস্যজনক আচরণ করা দুদক’র অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ পেয়ে তাকে আসামি করা হলেও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। ফলে তার জ্ঞাতআয়বহির্ভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদও জব্দ করা যাচ্ছে না। এটাকে কেউ কেউ সংস্থাটির অবহেলা বা গড়িমসি হিসাবে দেখছেন। আবার ১২ জুন যে ৫৮টি মামলায় বাচ্চুসহ ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুদক তার সব চার্জশিট এখনো আদালতে দাখিল করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘আমি যতদূর জানি আবদুল হাই বাচ্চু দেশেই আছেন। তিনি যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন এবং তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার বিদেশযাত্রা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। তবে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা এখন আদালত থেকে দেওয়া হয়। তাই দুদক’র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বাচ্চুর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১২ জুন বাচ্চুর বিরুদ্ধে ৫৮ মামলার চার্জশিট অনুমোদন দেয় কমিশন। এর ৪ দিন আগে ৮ জুন শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু নামের পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি কানাডা থেকে দেশে আসেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে এই নামে তার দেশে আসার রেকর্ড থাকলেও ৮ জুনের পর দেশত্যাগের কোনো রেকর্ড নেই। তবে ভিন্ন একটি সূত্রের দাবি, আব্দুল হাই বাচ্চু ও আব্দুল হাই নামে তার আরও দুটি পাসপোর্ট রয়েছে। তার যে কোনো একটি ব্যবহার করে তিনি দেশত্যাগ করতে পারেন। তাদের এই সন্দেহের কারণ, ১২ বছর ধরে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান ও তদন্ত করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। শুরু থেকেই তারা জানতেন ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে বাচ্চু জড়িত। এর দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না। তারপরও মামলার এজাহারে বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি তার দেশত্যাগে। ১২ জুন আকস্মিকভাবে বাচ্চুকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট অনুমোদন করা হয়েছে। আর এর আগে শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস করে চার্জশিট তৈরি করেছেন। ১২ বছর যাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে রেখেছে দুদক, তাকে বিদেশে পালানোর সুযোগ দিয়ে চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন আদালতের চাপ সামাল দিতেই বাচ্চুর অবস্থান সম্পর্কে কেউ কেউ পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।
তবে দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, তারা নিশ্চিত বাচ্চু এখনো দেশেই আছেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন তার অবস্থান এখন ঢাকার একটি বিশেষ এলাকায়। দেশে আসার পর থেকে তিনি সেখানেই আছেন। বনানী ডিওএইচএস (পুরাতন) আবাসিক এলাকায় তার নিজস্ব আরেকটি বাড়ি রয়েছে। দেশে আসার পর তিনি সেই বাড়িতে একদিনও থাকেননি। চার্জশিট অনুমোদনের কয়েক দিন পর পর্যন্তও তার ব্যবহৃত যে গ্রামীণ অপারেটরের মোবাইল ফোন সচল ছিল, গত ৪-৫ দিন ধরে সেটি বন্ধ রয়েছে। সমন্বিত সিদ্ধান্ত পেলেই দুদক যে কোনো সময় বাচ্চুকে গ্রেফতার করতে পারে বলে সূত্রটি দাবি করেছে।
দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, বাচ্চুর দেশে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা, দুদক উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহীম। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মহানগর দায়রা জজ আদালত বাচ্চুর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। এর আগে ১৫ জুন বাচ্চুর বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন, ল্যান্ড ও সি পোর্ট) বরাবর চিঠি দেয় দুদক।
জানা গেছে, অনুমোদিত চার্জশিটে আসামির তালিকার উল্লেখযোগ্য অন্যরা হলেন-ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. সেলিম, এমদাদুল হক, ফজলুল সোবহান, মহাব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান ও শাহজাহান মোল্লা, ডিজিএম খান ইকবাল হাসান, জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আশরাফুজ্জামান, ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. জালাল উদ্দিন, এজিএম এসএম আনিসুর রহমান চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী, গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক শীপার আহমেদ, একই শাখার ক্রেডিট ইনচার্জ এসএম জাহিদ হাসানসহ দিলকুশা শাখা ও স্থানীয় কার্যালয়ের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। এদের কেউ কেউ আদালতে জামিন নিতে গিয়ে কারাবন্দি হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বর্তমানে একমাত্র আসামি শান্তিনগর শাখার সাবেক জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী চৌধুরী কারাগারে আছেন।
২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। ৫ বছর অনুসন্ধান শেষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ৩ দিনে টানা ৫৬টি মামলা হয়। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় করা এসব মামলায় আসামি করা হয় ১২০ জনকে। এর মধ্যে ঋণগ্রহীতা ৮২ জন, ব্যাংকার ২৭ ও ১১ জন ভূমি জরিপকারী রয়েছেন। কোনো মামলায় আসামির তালিকায় নাম ছিল না ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুর।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে বাচ্চু চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে। ফলে ২০১৪ সালে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করা হয়। ওই বছরের ২৯ মে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ৪ জুলাই পদত্যাগপত্র জমা দেন বাচ্চু।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যখন মামলা করা হয় তখন দুদক চেয়ারম্যান ছিলেন মো. বদিউজ্জামান। তিনি থাকাকালে মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তারপর ২০১৬ সালে দুদক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ইকবাল মাহমুদ। তার ৫ বছরেও আলোচিত এ মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হয়নি। বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ দায়িত্ব পাওয়ারও ২ বছর পর ১২ জুন চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়। চার্জশিট অনুমোদন দিতে দুদকের সময় লেগেছে ৮ বছর।