এক বছরের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৫৬৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপরীতে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতির অনুপাত কমেছে। ফলে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে ঝুঁকির প্রবণতা কিছুটা কমেছে। তবে জিডিপির বিপরীতে বৈদেশিক ঋণের অনুপাত আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এ অনুপাত এখনো ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে। আলোচ্য সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে, কমেছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি কমলেও বেড়েছে সরকারি খাতের ঋণের স্থিতি। এদিকে ঋণ পরিশোধের চাপও কমে আসছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সরাসির বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বৈদেশিক ঋণবিষয়ক এ প্রতিবেদনটি প্রতি ছয় মাস পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জুন পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের ঋণ ৮ হাজার ৩২১ কোটি ডলার এবং বেসরকারি খাতে ২ হাজার ৫৭ কোটি ডলার। গত বছরের জুনে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৮১১ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি এবং বেসরকারি খাতে ২ হাজার ২২৬ কোটি ডলার। গত এক বছরের তুলনায় দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৫৬৮ কোটি ডলার বা ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বেড়েছে ৯ দশমিক ২ এবং স্বল্পমেয়াদী ঋণ কমেছে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। মোট ঋণের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ সরকারি খাতে এবং বেসরকারি খাতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
আলোচ্য ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮ হাজার ৯৬০ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৮ হাজার ৪২ কোটি এবং বেসরকারি খাতে ৯১৭ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ৪১৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে ২৭৯ কোটি এবং বেসরকারি খাতে ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। সরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কম, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেশি। এটিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখা হয়। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কম। এটিকে নেতিবাচক হিসাবে দেখা হয়। কারণ, স্বল্পমেয়াদি ঋণ অর্থনীতিতে ঝুঁকির সৃষ্টি করে।
মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে চীন থেকে ৩১৩ কোটি ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে যুক্তরাজ্য থেকে ১১০ কোটি ডলার, তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডস থেকে ৯২ কোটি ডলার। এছাড়া হংকং থেকে ৭৯ কোটি, সিঙ্গাপুর থেকে ৫৭ কোটি, জার্মানি থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ৫১০ কোটি, উৎপাদন খাতে ২০৮ কোটি এবং বাণিজ্য খাতে ১০৯ কোটি ডলার।
গত অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ করা হয়েছে ২৩০ কোটি এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ শোধ করা হয়েছে ২৬০ কোটি ডলার। গত বছরের জুনের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদী ঋণ পরিশোধ কিছুটা বেড়েছে। তবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ কিছুটা কমেছে। কারণ, গত সরকারের আমলে ডলার সংকটের কারণে ব্যাপকভাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ স্থগিত করা হয়েছে। যে কারণে এখন স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি পরিশোধ করা হচ্ছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জুনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপরীতে মোট বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ছিল ২৫ শতাংশ। গত জুনে তা কমে ২১ শতাংশে নেমেছে। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ বেড়েছে এবং ঋণ কমেছে। ফলে ঝুঁকিও কিছুটা কমেছে।
তবে দেশের মোট জিডিপির বিপরীতে বৈদেশিক ঋণের অনুপাত বেড়েছে। গত বছরের জুনে জিডিপির বিপরীতে ঋণের অনুপাত ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপির তুলনায় ঋণ বেশি বেড়েছে। তবে জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এখনো যথেষ্ট কম। জিডিপির ৫০ শতাংশের মতো বৈদেশিক ঋণকে ঝুঁকিমুক্ত ধরা হয়। এর বেশি হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, তিন অর্থবছর ধরে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমছে। বৈশ্বিক মন্দা ও দেশে ডলার সংকটের কারণে এতে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এফডিআই এসেছিল ১৭২ কোটি ১১ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে ১৬০ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে নামে। গত অর্থবছরে তা আরও কমে ১৪৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারে নামে। গত এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার বা ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত অর্থবছরে নিট পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ এসেছে ৬৬ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। দেশে কার্যরত বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ করেছে ৬১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ হিসাবে নিয়ে বিনিয়োগ করেছে ১৮ কোটি ৫৭ কোটি ডলার। ওই তিনটি উৎস থেকে বিনিয়োগ করা পুঁজিকে এফডিআই হিসাবে গণ্য করা হয়।
দুই বছর ধরে নিট পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ আনার প্রবণতা কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট পুঁজি এসেছিল ১১৩ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে এসেছিল ৭০ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে আরও কমে এসেছে ৬৬ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ আসার প্রবণতা কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। মুনাফা থেকে বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। তবে ঋণ থেকে বিনিয়োগ বেড়েছে ৬৬ দশমিক ১৯ শতাংশ।
বৈদেশিক মন্দার কারণে কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমায় আয় থেকে বিনিয়োগ কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মুনাফা থেকে বিনিয়োগ হয়েছিল ৭৮ কোটি ৮১ লাখ ডলার। গত বছরে বিনিয়োগ হয়েছে ৬১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ হয়েছিল ১১ কোটি ১৮ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে হয়েছে ১৮ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। এ খাতে ঋণ বেড়েছে।
গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে ২৯৯ কোটি ডলার। সিঙ্গাপুর থেকে ১৭৪ কোটি, কোরিয়া থেকে ১৫৬ কোটি, চীন থেকে ১৩৮ কোটি, নেদারল্যান্ডস থেকে ১২৭ কোটি, হংকং থেকে ১২৬ কোটি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০২ কোটি, ভারত থেকে ৮০ কোটি, মালয়েশিয়া থেকে ৭৮ কোটি এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে ৬১ কোটি ডলার।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে পুঁজি যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের উদ্যোক্তারা বৈধভাবে বিদেশে বিনিয়োগ নিয়েছিলেন ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে নতুন বিনিয়োগ যায়নি। বরং আগের চেয়ে ১২ লাখ ২০ হাজার ডলার কমেছে। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ কমেছে ১০৭ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরে নিট পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ গেছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ডলার। আন্তঃকোম্পানির বা এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ কমেছে ৩ কোটি ২৪ লাখ ডলার।