লেবাননে বিস্ফোরক দ্রব্যের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে বৈরুতের অর্ধেকই ধুলিস্যাৎ হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে একশ’র বেশি মানুষ।ধ্বংসস্তুপে তাদের খোঁজ করছে উদ্ধারকারীরা। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দু’সপ্তাহের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সরকার।
মঙ্গলবার বৈরুতের বন্দর এলাকায় বিস্ফোরণটি ঘটে। এর তীব্রতা এতটাই ছিল যে গোটা শহরই ভূমিকম্পের মত কেঁপে ওঠে। বহুদূর পর্যন্ত বাড়িঘর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কম্পন অনুভূত হয় ২৪০ কিলোমিটার দূরের দ্বীপরাষ্ট্রেও। অনেকেই মনে করেছিলেন ভূমিকম্প হয়েছে। ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ১শ’রও বেশি মানুষের। আহত হয়েছে ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ।
WARNING: GRAPHIC CONTENT – A large explosion shook the Lebanese capital Beirut and a giant column of smoke was seen rising over the city https://t.co/xH1q1gtlco pic.twitter.com/7wEKpCyjEg
— Reuters (@Reuters) August 4, 2020
লন্ডভন্ড হয়েছে শহর। ঘরহারা হয়েছে অন্তত ৩ লাখ মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে এ যেনো এক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ। বিস্ফোরণের সেই ভয়াবহতার চিত্র উঠে এসেছে বৈরুতের মার মিখায়েল এলাকার বাসিন্দাদের কথায়।
‘দোযখ নেমে এসেছিল’
বাসিন্দা আলি জাকারির কথায়, “প্রকাণ্ড একটা শব্দ, কোনওকিছুর আঘাত লাগল। মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারাই, আধামিনিট, একমিনিট… যেনো দোযখ নেমে এসেছিল।”
“মানুষজনের চিৎকার, চেঁচামেচি, আমরা চারিদিকে ছিটকে পড়ছিলাম, আগুনের ফুলকি উড়ছিল।”
আরেক বাসিন্দা তার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বলেন, “আমি কাজে যাচ্ছিলাম, বসতে যাওয়া মাত্রই পুরো অফিস আমার মাথার ওপরে এসে পড়ল।”
“আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না, সেটা বিস্ফোরণ না কী ছিল তা আমি জানিনা…কেবল বুঝতে পেরেছি, আমি উড়ে গিয়ে ধ্বংসস্তুপের নিচে পড়েছি।”
আলি ইরানি নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, “আমি প্রায় ৫শ’ মিটার দূরে মহাসড়কে ছিলাম। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমার গাড়ি প্রায় ৫ মিটার দূরে গিয়ে পড়ে। উড়ে যায় জানালা।”
‘ভাঙা কাচের ঘূর্ণিঝড়’
বৈরুতে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার এক সাংবাদিক বিবিসি রেডিও ফাইভ লাইভে বলেছেন, জানালার ভাঙা কাচের ঘূর্ণিঝড়ে পড়েছিলেন তিনি… এরপরই তিনি দেখেন বাড়ি ভেঙে পড়েছে। আশেপাশের বাড়িঘরও ভেঙে চুরমার হয়েছে।
বিবিসি’কে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের শব্দে কিছুক্ষণের জন্য তার কানে তালা লেগে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা ঘটেছে। আর তারপরই আশেপাশের দোকান, বাড়িঘর সবকিছু থেকে বৃষ্টির মতো কাচ ভেঙে পড়তে দেখেন তিনি।
ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হাসপাতালেও
প্রকাণ্ড বিস্ফোরণে হাসপাতালও টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন এক চিকিৎসক। তিনি জানান, তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালের গাড়ি পার্কিং এলাকাতেই লোকজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
“মানুষজন আতঙ্কিত ছিল। হাসপাতালের অনেক কর্মচারীও মারাত্মক আহত হয়েছিল। তারপরও তাদেরকে আইসিইউ তে থাকা রোগীদের দেখভাল করতে হয়েছে।”
হাসপাতালের বিপর্যয়কর অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন বৈরুতের এক বাসিন্দাও। হাসপাতালের মাটিতে ১শ’ দেড়শ মানুষকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।
তার কথায়, “চারিদিকে রক্ত, লোকজন আর্তনাদ করছে। এরকম দৃশ্য জীবনে কখনও দেখিনি। যেনো মনে হচ্ছিল এক হলিউডি সিনেমার দৃশ্য। কিন্তু দুঃখজনক, এমনটি সত্যিই ঘটেছে।”
শত শত কোটি ডলারের ক্ষতি
লেবাননের অর্থমন্ত্রী বৈরুতের বন্দর নগরীর বিস্ফোরণকে `বিপর্যয়কর’ আখ্যা দিয়েছেন। এতে শতশত কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বিস্ফোরণের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনারও অঙ্গীকার করেছেন মন্ত্রী। বিবিসি’কে তিনি বলেন, “এমন একটি বাড়ি নেই, দোকান নেই, এপার্টমেন্ট নেই যেটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি”।
“এ বিস্ফোরণ আসলেই বিপর্যয়কর। বন্দরের আশেপাশে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বিস্ফোরণ যেখানে ঘটেছে সেখানে আসলে সবকিছুই সাগরের নিচে চলে গেছে।”
“একখন্ড ভূমি ছিল। সেটা এখন সাগরে চলে গেছে, পুরোই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা শত শত কোটি ডলারের ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে বলছি। তবে আসলেই কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনও আমরা জানিনা।”
বৈরুতের গভর্নর মারওয়ান আবৌদ তিন লাখ মানুষের গৃহহীন হয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন। ৩শ কোটি থেকে ৫শ কোটি ডলারের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
প্রিয়জনদের খুঁজছে মানুষ,পাশে দাঁড়িয়েছে ইইউ-ফ্রান্স
শহরের কয়েকটি ছবিতে রাস্তার পর রাস্তা ধ্বংস হয়ে যেতে দেখা গেছে। মানুষের বাড়িঘরেরও একই দশা। এ বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে প্রিয়জনদের খুঁজে ফিরছে মানুষ।
ধ্বংসস্তুপের মধ্যে উদ্ধারকারীরা মৃত এবং জীবিতদের সন্ধান করছে। পাশাপাশি অনলাইনেও নিখোঁজদের অনুসন্ধান করছে মানুষ। এরই মধ্যে ‘লোকেটিং ভিক্টিমস বৈরুত’ ইন্সটাগ্রাম একাউন্টের অনুসারী হয়েছে ৮০ হাজার মানুষ।
বিস্ফোরণের পর থেকে যাদের খোঁজ মিলছে না তাদের সন্ধান পেতে সহায়তা চেয়ে অনুরোধ করা হচ্ছে এই একাউন্টে।
লেবাননের গনজণের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউ’র ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিশনার বৈরুতে উদ্ধারকাজে জন্য ১শ’র বেশি উচ্চপ্রশিক্ষিত দমকলকর্মী এবং গাড়িসহ, কুকুর ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন।
ফ্রান্স উদ্ধারকারীসহ তিনটি বিমান, চিকিৎসা সরঞ্জাম বৈরুতে পাঠানোসহ মোবাইল ক্লিনিকের ব্যবস্থা করছে। নেদারল্যান্ডস, গ্রিস, এবং চেক রিপাবলিকও বৈরুতের সহায়তায় পাশে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছে।