করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকানোর অদ্ভুত এক যুদ্ধে নতুন বছর উদযাপনে বাঙালির উৎসবের রঙও হারাল।
মঙ্গলবার নতুন বছরের আগমনী বার্তা ঘোষিত হবে না ঢাকার রমনার বটমূল থেকে, বর্ণিল মঙ্গল শোভাযাত্রাও বের হবে না চারুকলা থেকে, উৎসবেও মাতবে না দেশের প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।
তবুও সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঘরে ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাবে, শুরু হবে ১৪২৭ সাল। তবে এমন বর্ষবরণ আগে দেখেনি কেউ।
ফসলি সন হিসেবে মুঘল আমলে যে বর্ষগণনার সূচনা হয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে রূপ নেয়; শুধু তাই নয় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলীয়ান করে বাঙালিকে লড়াইয়ের প্রেরণাও দিয়ে আসছে এই উৎসব।
আনন্দের এই দিনটি নিরানন্দের করে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস,যা বিশ্বে মহামারীর রূপ নেওয়ার পর বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে, আক্রান্ত করেছে আট শতাধিককে, মৃত্যু ঘটিয়েছে ৩৯ জনের।
‘বর্ণহীন’ বৈশাখের বিকল্প আয়োজনে ‘ভয় জয়ের অভয়’
এই পরিস্থিতিতেও বর্ষবরণের আয়োজন নিজ নিজ ঘরেই করার আহ্বান এসেছে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের কাছ থেকে; কারণ আনন্দের চেয়ে সতর্কতার উপরই এখন জোর দেওয়া হচ্ছে।
এক বছর আগে ১৪২৬ সালের প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাগ ললিতে রমনা বটমূলে শুরু হয়েছিল ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগটি ছোঁয়াচে। এর কোনো টিকা কিংবা ওষুধ এখনও নেই বলে প্রতিরোধই সর্বোত্তম পন্থা।
আর এই প্রতিরোদ করতে গিয়েই এখন বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ঘরবন্দি, যা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে গত ২৬ মার্চ থেকে। এই অবস্থা চলবে কতদিন, তা এখনও অনিশ্চিত।
“এটা করা হয়েছে বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে। কারণ, ইতোমধ্যেই এই ভাইরাস আমাদের দেশেও ভয়াল থাবা বসাতে শুরু করেছে,“ বৈশাখ উপলক্ষে সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আনন্দঘনর এই দিনটি বেদনার রঙে যেন সম্পূর্ণ না হারায়, সেজন্য ঘরে উদযাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
“সবাইকে অনুরোধ করব কাঁচা আম, জাম, পেয়ারা, তরমুজসহ নানা মওসুমী ফল সংগ্রহ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে বসেই নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন।”
সেই সঙ্গে সংক্রমণ এড়ানোর জন্য সতর্কতার কথাও মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি।
“আপনারা বিনা কারণে ঘরের বাইরে যাবেন না। অযথা কোথাও ভিড় করবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করুন, পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করুন।”
অনুজীবের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ভয় না পাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, জরা-জঞ্জাল ধুয়ে নতুন বছর নতুনভাবে শুরু হবে বাঙালির জীবনে।
নববর্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাণীতেও সতর্কতার সুর।
“এ বছর এমন একটা সময়ে আমরা বাংলা নববর্ষের দিনটি অতিবাহিত করছি, যখন সারাবিশ্ব নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে।
“বাংলাদেশও আজ এ ভাইরাসের আক্রমণের শিকার। তাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে দেশ ও দেশের জনগণকে করোনার ছোবল থেকে রক্ষা করা। আর এজন্য স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।”
আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হয়ে এই সঙ্কট মোকাবেলার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আসুন… নিজে সতর্ক হই, অন্যকেও সতর্ক করি।”
সব বন্ধের এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ডিজিটাল পদ্ধতিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে।
এজন্য একটি অনুষ্ঠান ১৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সব সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে একযোগে সম্প্রচার করা হবে।
পহেলা বৈশাখে সকাল ৭টা থেকে অনুষ্ঠানগুলো বিটিভিসহ ছায়ানটের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেইজে সম্প্রচার করা হবে। অনুষ্ঠান শেষে ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন এবারের নববর্ষের পটভূমিতে বক্তব্য রাখবেন।
ছায়ানটের কার্যকরি সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, “সময়টা খারাপ যাচ্ছে, এই নতুন বছরে এর প্রতিষেধক বের হবে এবং বিজ্ঞানের জয়যাত্রা হবে বলে আমি আশা করছি।”
মঙ্গল শোভাযাত্রা না হলেও সময়ের প্রেক্ষিতে ভয় জয়ের আহ্বান জানিয়ে একটি পোস্টার বের করেছেন আয়োজকরা।
কালো রঙের সেই পোস্টারে কালজয়ী কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ সেই কথাটি স্লোগান হিসেবে স্থান পেয়েছে- ‘মানুষ ধ্বংস হতে, কিন্তু পরাজিত হয় না’।