ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ। সম্প্রতি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ শ্রেণীকরণের নীতিমালা শিথিল করেছে। ব্যাংক খাতের নানা সংকট ও সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নরের বিশেষ মন্তব্য-
বর্তমান অর্থমন্ত্রী বলছেন, ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক। আগের অর্থমন্ত্রীও ব্যাংক খাত সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তাদের এমন প্রতিক্রিয়ার প্রভাব নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আমি প্রথমে বলব, ব্যাংক খাতের চলমান যে অবস্থা, তাতে সরকারকে কোনোভাবেই নিষ্ফ্ক্রিয় থাকা ঠিক হবে না। অগ্রণী হয়ে কিছু সংস্কার করা সরকারের জন্য অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
বলা যায়, ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে। তবে অবস্থা এত খারাপ হয়নি যে, এর প্রতিকার করা যাবে না। প্রতিকার মানে ধরো-মারো, জেলে দাও- তা কিন্তু নয়। আইনকানুনের মধ্যে থেকেই প্রতিবিধান সম্ভব। ব্যাংক খাতে সবার জন্য সমান ব্যবস্থা থাকতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হয়েছে, তাদের কোনো অবস্থাতেই যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন- এমন গ্রাহকদের চেয়ে বেশি সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না। এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রচলিত নিয়মে ঋণের ১০ ভাগ এককালীন জমা বা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করা যায়। এটা তো এখন উল্টে যাচ্ছে। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘমেয়াদের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দিলে ব্যাংক খাতের কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি-না, তার ওপর নিরীক্ষা দরকার। এ বিষয়ে বাইরের লোক দিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিচার-বিশ্নেষণ করাতে হবে।
সরকার ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে একটি ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। আমি মনে করি, এখন একটা আর্থিক ও ব্যাংক খাত সংস্কার কমিশন করা দরকার। এ কমিশন হবে পরামর্শমূলক। এর কোনো নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে না। শুধু বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিটি ইস্যু বিচার-বিশ্নেষণ করে সুপারিশ করবে। যেমন- পুনঃতফসিল করতে হলে কোন ব্যাকরণ অনুসরণ করতে হবে, কত ডাউন পেমেন্ট হবে, কত বছরের জন্য করা হবে, পুনঃতফসিলের শর্ত ভঙ্গ করলে কী ব্যবস্থা নিতে হবে- এসব বিষয়ে কমিশন সুপারিশ করবে। সরকারের বাইরে অথচ সরকারের আস্থাভাজন বিজ্ঞ কাউকে দিয়ে এক বছর বা দুই বছর মেয়াদি আর্থিক ও ব্যাংক খাত সংস্কারে শক্তিশালী কমিশন গঠন করা যেতে পারে। আর্থিক খাত এ জন্য বলছি যে, সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাজার, বীমা ও পেনশন ফান্ড থেকে দীর্ঘমেয়াদের জন্য বিনিয়োগযোগ্য তহবিল আহরণ করা হয়। আমাদের এখানে পুঁজিবাজার সেই ভূমিকায় নেই। বীমা ফান্ডে প্রচুর অলস টাকা পড়ে আছে। আমাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডগুলোও নানা জায়গায় পড়ে আছে। এসব ফান্ড থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অর্থায়ন হলে ব্যাংকের ওপর চাপ কমে যাবে। ব্যাংক তখন শুধু বাণিজ্যিক খাত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কিংবা শিল্পে চলতি মূলধন জোগানের মতো স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেবে।
আরেকটা বিষয় হলো, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এখন আগের চেয়ে একই পরিবারের বেশি সদস্য থাকতে পারেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম নীতিকৌশল হলো, সমাজে বৈষম্য বাড়ানো যাবে না এবং অর্থনৈতিক শক্তি কতিপয় হাতে কেন্দ্রীভূত থাকতে দেওয়া যাবে না। বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক আধিপত্য বাড়ানোর জন্য যে পরিবর্তন হয়েছে, তা বৈষম্য কমানোর ওই নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ বিষয়ে সরকারের নীতিকৌশল জেনে ওই কমিশন বিচার-বিশ্নেষণ করবে।
ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি-না- এমন আলোচনা আমরা প্রায়ই শুনছি। নব্বইয়ের দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ক্ষমতা ছিল, বর্তমানে এর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা রয়েছে। এক সময় মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তন অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে ছিল। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ রকম অনেক কিছু আছে। যেমন- ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। আমি মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা কতটুকু আছে তার চেয়ে বড় বিষয় ক্ষমতা কীভাবে প্রয়োগ করবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ে থাকা ব্যাংকিং বিভাগের কার্যক্রম স্থগিত করেছিলেন। ২০০৯ সালে এসে আবার কাদের পরামর্শে এটি পুনর্বহাল করা হলো জানি না। এতে কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হলো, কিছুটা অস্পষ্টতা তৈরি হলো। এ বিভাগ ব্যাংক খাতের ওপর তদারকি বাদ দিয়ে বীমা, মূলধন বাজার, প্রভিডেন্ট ফান্ড- এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারে। এখানে একটা সংস্কার দরকার। আর সরকারি ব্যাংকগুলো দিয়ে আগের মতো সামাজিক সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড করাবে নাকি এসব ব্যাংক বাজারে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে সে বিষয়ে সরকারের নীতিগত অবস্থান ঠিক করতে হবে।