বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিসহ অন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে প্রচুর ঋণ পাওয়ার পরও গেল অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। ঋণের এই অংক আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১০৯ শতাংশ বেশি।
রাজস্ব আদায়ে নাজুক অবস্থা এবং সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরের শুরু থেকেই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেওয়ার প্রবণতা ছিল। তার মধ্যে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অর্থনীতির সব হিসাব এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় সেই ঋণনির্ভরতা আরও বেড়েছে।
অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের মত ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ রেকর্ড ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছর সরকার ব্যাংক থেকে ৩৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা নিয়েছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঋণের অংক ছিল ১১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
বিআইডিএসের গবেষক জায়েদ বখত মনে করেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতে ঋণের যে চাহিদা, তাতে সরকারের ঋণ বাড়ায় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বরং সরকার এবং ব্যাংক দুই পক্ষই এতে উপকৃত হচ্ছে।
তিনি বলেন, “সরকার সঞ্চয়পত্রের তুলনায় কম সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলো টাকা অলস ফেলে না রেখে ঝুঁকিমুক্ত বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে।”
ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীরগতির কারণে গেল অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের পরিস্থিতি ভালো ছিল না। করোনাভাইরাসের মহামারী শুরুর পর অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রাজস্ব আদায় কমেছে ব্যাপক হারে। এ অবস্থায় ৪৫ বছর পর রাজস্ব আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে কম হয়েছে এবার।
গত অর্থবছরের মূল বাজেটে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে তিন লাখ ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেখা যায়, ২০১৯-২৯ অর্থবছরে আয় হয়েছে মাত্র ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৮৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কম।
এপ্রিল থেকে জুন-এই তিন মাসে বিশ্ব ব্যাংক ১৬০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশকে। এডিবি দিয়েছে ৬০ কোটি ২৮ লাখ ডলার।
নানা শর্তের কারণে আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ পাওয়া তুলনামূলকভাবে কঠিন। সেই আইএমএফের কাছ থেকেও মাত্র এক মাসের দর-কষাকষিতে ৭৩ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা মিলেছে।চীনের নেতৃত্বে গঠিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) গত এপ্রিলে ১৭ কোটি ডলার দিয়েছে।
সঙ্কটকালে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ পেতে সরকারের তৎপরতায় সন্তোষ প্রকাশ করে তার যথাযথ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “সরকার দেশের সঙ্কটে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে ভালোভাবেই উপস্থাপন করতে পেরেছে। সে কারণেই তারা দ্রুত সাড়া দিচ্ছে।
“এখন আমাদের কাজ হবে এই টাকার যথাযথ ব্যবহার। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার সঙ্গে এই টাকা খরচ করতে হবে।”
২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা ছিল। তবে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা করা হয়।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে প্রচুর ঋণ পাওয়ায় সরকার ব্যাংক থেকে তেমন ঋণ নেয়নি।
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৬ থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ পায়। অথচ সঞ্চয়পত্রে গুণতে হয় ১১ দশমিক শূন্য ৪ থেকে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
তবে গত কয়েক বছরে প্রচুর সঞ্চয়পত্র বিক্রির ফলে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে গেছে। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সুদ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ স্থিতি রয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা।
সুদ কমাতে সঞ্চয়পত্র কেনার সীমা কমিয়ে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও টিআইএন বাধ্যতামূলক করাসহ নানা উপায়ে বিক্রি নিরুৎসাহিত করছে সরকার। নতুন বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রি পরিস্থিতি নাজুক হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা করা হয়।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) যে তথ্য জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর প্রকাশ করেছে, তাতে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ১০ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে।