কদিন আগেই শেষ হলো যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। আর এ বছরই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলো ভারতে।
দুটি দেশেরই আইনসভা দুই কক্ষবিশিষ্ট। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশই দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার রীতি অনুসরণ করে।
দুই কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থা বা বাইক্যামেরালিজম হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে আইনসভা দুটি পৃথক কক্ষে বিভক্ত থাকে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ শাসনব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি। এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও পর্যালোচনা নিশ্চিত করা।
বিপরীতে এক কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থা বা ইউনিক্যামেরালিজম হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে আইনসভা শুধুমাত্র একটি কক্ষ নিয়ে গঠিত। এটি একটি বিকল্প মডেল হিসেবে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে কিছুটা সরল করে তোলে।
দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার মূল উদ্দেশ্য হলো একক কক্ষের হাতে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ ও অপব্যবহারের ঝুঁকি এড়ানো। সমান ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি কক্ষের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিলে একক কক্ষের অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার শঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো, সরকারের ক্ষমতার যথাযথ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা এবং সরকারের কর্মকাণ্ডকে সীমিত রাখা।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, একক কক্ষ এই ভূমিকা কার্যকরভাবে পালন করতে পারে না, কারণ সেই কক্ষের বেশিরভাগ সদস্য সাধারণত সরকারদলীয় প্রতিনিধিরা হয়ে থাকে এবং তারা সরকারের নির্দেশ অনুসারে ভোট দেয়। সমান ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় একটি কক্ষ থাকলে, সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর আরও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।
এ ছাড়া দুই কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থা আইনসভার প্রতিনিধিত্বমূলক ক্ষমতা বাড়ায়, কারণ এতে বিভিন্ন ভোটিং পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়। ভিন্ন ভোটিং পদ্ধতির ফলে সংসদে বিভিন্ন স্বার্থ ও মতামতের সমন্বয় ঘটে, যা একে আরও গণতান্ত্রিক ও জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে।
৭৮ দেশে দুই কক্ষের সংসদ
আন্তর্জাতিক সংসদীয় ইউনিয়নের (আইপিইউ) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯০টি জাতীয় সংসদের মধ্যে, ৭৮টি দুই কক্ষবিশিষ্ট (মোট ১৫৬টি কক্ষ) এবং ১১২টি এক কক্ষবিশিষ্ট। অর্থাৎ সদস্য দেশগুলোতে মোট ২৬৮টি সংসদীয় কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার। আইপিইউর সদস্য ১৮১টি।
প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থার চর্চা ছিল। যদিও এগুলো পুরোপুরি দ্বিকক্ষীয় কাঠামো ছিল না। এথেন্সে শাসন ব্যবস্থায় দুটি প্রধান সংস্থা ছিল। প্রথমটি হলো এক্লেসিয়া, যেখানে সাধারণ নাগরিকেরা অংশ নিতেন। দ্বিতীয়টি অ্যারিওপেগাস বা পরামর্শদাতা পরিষদ।
রোমে সিনেট অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত, আর প্লেবিয়ান অ্যাসেম্বলি সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগ ও মতামত প্রকাশের একটি মঞ্চ ছিল। এসব ব্যবস্থা বিভিন্ন সামাজিক স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষার ধারণা প্রতিফলিত করত। এ ধরনের প্রাথমিক কাঠামো পরবর্তী দ্বিকক্ষীয় আইনসভাগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
প্রথম দ্বিকক্ষ সংসদ ব্রিটেনে
ইংলিশ পার্লামেন্টই প্রকৃতপক্ষে প্রথম দ্বিকক্ষীয় আইনসভা গঠন করে। সেখানে হাউস অব লর্ডস ও হাউস অব কমন্স নামে দুটি কক্ষ ছিল। প্রথমটি অভিজাত ও ধর্মীয় নেতাদের জন্য। দ্বিতীয়টি সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করত।
এই বিভাজন তখনকার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ভূমিকা ও স্বার্থের পার্থক্যের কারণে প্রয়োজন হয়েছিল। আর এই কাঠামো পরবর্তী সময়ে দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থাগুলোর জন্য একটি আদর্শ হয়ে ওঠে, যেখানে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয় ১৮ শতাব্দীতে। এতে রয়েছে সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস নামে দুটি কক্ষ। দেশটিতে নির্বাচন ব্যবস্থাও অন্যান্য দেশের চেয়ে আলাদা। ১৮ ও ১৯ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্বিকক্ষীয় আইনসভা গঠিত হয়। ফ্রান্স ও ইতালির মতো ইউনিটারি রাষ্ট্রে দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল, যেখানে অভিজাত শ্রেণি এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভাজন নিশ্চিত করা হয়।
অন্যদিকে, পরে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মতো ফেডারেল রাষ্ট্রে আঞ্চলিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থা গঠন করা হয়েছিল। ইউরোপীয় দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থার ইতিহাসের উপর বিশ্লেষণ পাওয়া যায় এরিক হবসবাম ও ম্যাক্স ওয়েবারের মতো রাজনৈতিক ইতিহাসবিদদের লেখায়।
এরপর বিশ্বের অনেক দেশেই, বিশেষত কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মতো ফেডারেল রাষ্ট্রে দ্বিকক্ষীয় আইনসভা গঠিত হয়। কিছু ইউনিটারি রাষ্ট্র যেমন ফ্রান্স ও ইতালিতেও দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থা রাখা হয় যাতে আইন প্রণয়ন এবং শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্য থাকে।
দ্বিকক্ষীয় আইনসভা ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এটি প্রথমে সামাজিক শ্রেণির ভারসাম্য এবং আঞ্চলিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য গড়ে ওঠে, এবং পরবর্তী সময়ে ফেডারেল ও ইউনিটারি রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়।
নিঃসন্দেহে দ্বিকক্ষীয় আইনসভা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। তবে এটি বিশেষত বড় ও বৈচিত্র্যময় সমাজের জন্য কার্যকর, যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বা অঞ্চলের স্বার্থ রক্ষা করা প্রয়োজন।
ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে দ্বিকক্ষ সংসদ
বাইক্যামেরাল সিস্টেম মূলত ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে। দুটি কক্ষে আইন পাসের বাধ্যবাধকতার কারণে গভীর পর্যবেক্ষণ ও ভারসাম্য নিশ্চিত হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সমন্বয় অঙ্গরাজ্য ও জনসংখ্যার ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে।
দ্বিকক্ষীয় কাঠামো বিভিন্ন অঞ্চলের বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। এটি বৃহৎ ফেডারেল রাষ্ট্রে বিশেষভাবে কার্যকর। যেমন ভারতের রাজ্যসভা রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে লোকসভা জনগণের। ফলে প্রতিনিধিত্বের মধ্যেও বৈচিত্র্য দেখা যায়।
কোনো আইন পাসের ক্ষেত্রে দ্বিকক্ষীয় আইনসভায় আইনের গভীর পর্যালোচনা হয়। আইন পাসের প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় কক্ষ মূল্যায়নের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ দেয়। এতে ত্রুটি সংশোধন সহজ হয় পাশাপাশি তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা আইন প্রণয়নের ঝুঁকি কমে।
দুটি কক্ষের পৃথক কার্যক্রম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং অযাচিত আধিপত্য রোধ করে। তবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বাধ্যবাধকতা প্রক্রিয়া আইন পাসের প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘ করে তোলে। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
এ ছাড়া দুটি কক্ষের মধ্যে মতানৈক্য ও সংঘাত দেখা দিলে আইন প্রণয়ন জটিল হয়ে পড়ে। যেমন কোনো কক্ষে আইন পাস হলে অন্য কক্ষে তা প্রত্যাখ্যাত হতে পারে, যা রাজনৈতিক অচলাবস্থা পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া দুটি কক্ষ পরিচালনা করতেও বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়, যা অনেক সময় রাষ্ট্রের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। ছোট বা একজাতীয় রাষ্ট্রে দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থা জটিলতা সৃষ্টি করে।
দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় সাধারণত নিম্নকক্ষের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। দেশভেদে নির্বাচন প্রক্রিয়া আলাদা হতে পারে।
নির্বাচন ব্যবস্থা যেমন
উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, যেমন কিছু দেশে উচ্চকক্ষের সদস্যরাও সরাসরি নির্বাচিত হন। আবার পরোক্ষ নির্বাচনও দেখা যায়। যেমন বিভিন্ন প্রাদেশিক পরিষদ বা স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধির মাধ্যমে সদস্য নির্বাচন করা হয়। কিংবা রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বিশেষজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনীত করতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে দুই কক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া ভিন্ন এবং এটি দেশের ফেডারেল কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। সিনেটের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন।
কংগ্রেসের দুই ধরনের সদস্যের মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন দুই বছরের জন্য। এবারের নির্বাচনে মার্কিন নিম্নকক্ষের ৪৩৫টি আসনের সব কটিতেই ভোট হয়েছে। অন্যদিকে সিনেট সদস্যদের মেয়াদ হয়ে থাকে ছয় বছর। তবে প্রতি দুই বছর পরপর সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না। ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ নামে এক পদ্ধতিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় আইনের একটি জটিল ব্যবস্থা, যা দেশটির সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত।
‘কলেজ’ শব্দটির অর্থ এখানে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট দেওয়ার অধিকারী। ইলেকটোরাল কলেজ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ইলেকটরস বলা হয়। এরা এক কথায় নির্বাচকমণ্ডলী। প্রতি চার বছর পর পর এটি গঠন করা হয় এবং তারাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট বাছাই করেন।
কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে প্রতিটি স্টেট বা অঙ্গরাজ্যে ইলেকটরসের সংখ্যা নির্ধারিত হয়: যা নির্ধারিত হয় স্টেটে সিনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক স্টেটে দুইজন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলে। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুযায়ী যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি, সেসব রাজ্যে ইলেকটোরাল ভোটও বেশি।
যদিও দুই কক্ষ ব্যবস্থা এখনো বিশ্বের অনেক দেশে কার্যকরী, তবে এর কার্যকারিতা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক রয়েছে। নিউজিল্যান্ড ১৯৫১ সালে দ্বিকক্ষীয় কাঠামো বাতিল করে ইউনিক্যামেরাল ব্যবস্থায় ফেরে।
দ্বিকক্ষীয় আইনসভা বৃহৎ এবং বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্রের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা হলেও চীনের আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট। এর নাম হলো ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস। অন্যদিকে রাশিয়ার আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এটি ফেডারেল অ্যাসেম্বলি নামে পরিচিত। এটি দেশের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে কার্যত রাষ্ট্রপতি আইনসভার চেয়ে বেশি প্রভাবশালী।