ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পারদ হঠাৎই নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। যুদ্ধের দামামার বদলে তৈরি হয়েছে সমঝোতার আবহ। দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশ পরস্পরের ভূখণ্ডে নজিরবিহীন বিমান হামলা চালানোর পর যুদ্ধের শঙ্কা দেখা দিলেও গতকাল বৃহস্পতিবার সুর নরম করেছে উভয় দেশ।
উত্তেজনা প্রশমনে পাকিস্তানে বন্দি ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। আজ শুক্রবারই তাকে ভারতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, তারা এ অঞ্চলে শান্তি রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে দুই দেশের সেনাবাহিনীই বিবৃতি দিয়ে বলেছে, তারা যে কোনো আগ্রাসন মোকাবেলায় প্রস্তুত। খবর বিবিসি, ডন ও এনডিটিভির।
দুই সপ্তাহ আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে।
হামলায় ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪৯ জওয়ান নিহত হন। ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার ভোররাতে ভারতের বিমানবাহিনী পাকিস্তানের বালাকোটে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করলে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। ইসলামাবাদ দাবি করেছে, বুধবার সকালে কাশ্মীরে তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশে ভারতীয় দুটি মিগ-২১ জঙ্গিবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। অন্যদিকে ভারতের দাবি, তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করা একটি পাকিস্তানি এফ-১৬-কে গুলি করে ভূপাতিত করেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী।
চির বৈরী দুটি দেশের উত্তেজনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। সংঘাত এড়িয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশকে সমস্যা মেটানোর আহ্বান জানান বিশ্বনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে কিছুটা ভালো খবর পাওয়া গেছে। ভিয়েতনামে উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠকের পর এ কথা জানান তিনি। দু’দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে দেশ দুটির নেতাদের সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেলজয়ী পাকিস্তানি নাগরিক মালালা ইউসুফজাই। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আলোচনার ডাককে স্বাগত জানিয়েছেন। উত্তেজনা প্রশমনে আবুধাবির যুবরাজ ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
শান্তি চান ইমরান :প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, শান্তির নিদর্শন হিসেবে শুক্রবারই ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেবে পাকিস্তান। গতকাল পার্লামেন্টে এক যৌথ অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে আমি ঘোষণা করছি যে, খোলাখুলি আলোচনার প্রথম ধাপ হিসেবে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাকে শুক্রবার আমাদের হেফাজত থেকে পাকিস্তান মুক্তি দেবে।’
এর আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি পাকিস্তানের জিও টিভিকে বলেছিলেন, অভিনন্দনকে ফিরিয়ে দিলে যদি সংঘাত এড়ানো যায়, তাহলে পাকিস্তান তাকে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছুক। এ ব্যাপারে ইমরান খান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলতে চান। বুধবার পাকিস্তান ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমান ভূপাতিত করার পর বিমানটির উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে আটক করে।
ইমরান খান আলোচনার জন্য যে প্রস্তাব তুলেছেন তাতে ভারতের সায় দেওয়ার সম্ভাবনা কতটা রয়েছে- জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, ভারতের প্রত্যক্ষভাবে এখনই এ মুহূর্তে সায় দেওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও শেষ পর্যন্ত এটা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সমাপ্তি টানতে হবে। কারণ দু’পক্ষের কারও জন্যই এই যুদ্ধ ইতিবাচক নয়। তার ওপর গোটা দক্ষিণ এশিয়া, এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের ভেতরেও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কোনো পক্ষ খুব বেশি অগ্রসর হতে পারবে না।
তবু রণপ্রস্তুতি, সেনাদের কড়া সুর :উত্তেজনা দৃশ্যত কমলেও দু’দেশের সেনাবাহিনীই গতকাল প্রতিপক্ষকে কড়া সুর শুনিয়েছে। জানিয়েছে, যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত।
ভারতের সেনাবাহিনী, নৌসেনা ও বিমানবাহিনীর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের থেকে যে কোনোরকম প্ররোচনার জবাব দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল তারা। মেজর জেনারেল সুরেন্দ্র সিং মহল বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীকে টার্গেট করেছে পাকিস্তান। তারা উত্তেজনা তৈরি করেছে। তারা যদি আমাদের আরও প্ররোচনা দেয়, আমরা চরম প্রত্যাঘাতের জন্য তৈরি।’ তিনি বলেন, বুধবার জম্মু-কাশ্মীরের একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার, একটি ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার এবং একটি লজিসটিক্স স্থাপনাকে টার্গেট করেছিল পাকিস্তান।
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীও বলেছে, তারা যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছে। সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে দেশটির সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীকে। গতকাল পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে ভারতের যে কোনো আগ্রাসনের জবাব দিতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, শুধু সেনাবাহিনী নয়, পাকিস্তানের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গত ৪৮ ঘণ্টায় ভারতীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখার কোটলি, খুইরাত্তা ও টাট্টা পনি সেক্টরে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করতে সেনাসংখ্যা বাড়িয়েছে।
কাশ্মীর সীমান্তের সর্বশেষ অবস্থা :ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বুধবার চরম উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন কাটানোর পর লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বা নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পাশে বেশ থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে জানায় বিবিসি। ভারতশাসিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার কৃষ্ণাঘাঁটি অঞ্চলে গতকাল দুই দেশের সেনাদের মধ্যে আবারও গুলিবিনিময় হয়েছে। তবে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা থেমেও গেছে।
মঙ্গল ও বুধবারের ভারত আর পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি বিমান হামলার পর গতকাল তুলনামূলকভাবে শান্তই রয়েছে নিয়ন্ত্রণরেখা। বুধবার সকালে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী ভারতে বোমাবর্ষণ করার পর যেসব বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, তাও তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে দুই দেশই তাদের সীমান্ত অঞ্চলে সব ধরনের সতর্কতা নিয়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা বাংলাদেশ সীমান্তেও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
মৃত্যু দেখতে চাই না- ফাতিমা ভুট্টো :পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনি লেখিকা ফাতিমা ভুট্টো বলেছেন, তার দেশের মানুষ আর যুদ্ধ দেখতে চায় না।
নিউইয়র্ক টাইমসে এক কলামে ৩৬ বছর বয়সী ফাতিমা লিখেছেন, ‘যুদ্ধে যুদ্ধেই একটি জীবনকাল পার করেছি আমরা। পাকিস্তানি সৈন্যদের মৃত্যু দেখতে চাই না আমি। ভারতীয় সৈন্যদেরও মৃত্যু দেখতে চাই না। এতিমদের একটি উপমহাদেশ চাই না আমরা।’ তিনি লিখেছেন, ‘সামরিক একনায়কতন্ত্র এবং সন্ত্রাসবাদ ও অনিশ্চয়তার লম্বা ইতিহাসের কারণে আমাদের প্রজন্মের পাকিস্তানিদের মধ্যে উগ্র দেশপ্রেম বা যুদ্ধের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, এটি আমাদের সহ্যাতীত।’
জনমানবহীন জঙ্গলে ভারতের বিমান হামলা, কেউ হতাহত হয়নি- আলজাজিরা :মঙ্গলবার ভোররাতে পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতের বিমান হামলা চালানো হয় কার্যত জনবসতিশূন্য একটি বনে এবং একজন কৃষকের মাঠে। এতে কেউ হতাহত হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের বরাতে এ কথা জানিয়েছে আলজাজিরা। তবে ওই এলাকাটিতে কট্টরপন্থি জয়শ-ই-মোহাম্মদ পরিচালিত একটি মাদ্রাসা রয়েছে।
সরেজমিন আলজাজিরার সাংবাদিক দেখতে পান, ইসলামাবাদ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের জাবা শহরটির একটি বন ও একটি মাঠে চারটি বোমা পড়েছে। এতে সেখানে গর্তের সৃষ্টি হলেও কোনো ভবনের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সেখানে বোমার ধাতব দেখা যায়।
বিমান হামলার পর ভারত দাবি করে, হামলায় জয়শের সাড়ে তিনশ’ জঙ্গি মারা গেছে। তবে পাকিস্তান হামলার তথ্য স্বীকার করলেও বলেছে, জায়গাটি জনবসতিহীন এবং হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।