চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ ঢাকায় আসছেন ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক। সকাল ১০টায় একটি বিশেষ ফ্লাইটে তার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার কথা রয়েছে। এই সফরে তার সঙ্গে রানি জেতসুন পেমাসহ একটি প্রতিনিধি দল থাকছে। সফরকালে রাজা ও রানি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং একটি নবায়ন হবে। আওয়ামী লীগ সরকার গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর এটি বাংলাদেশে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার প্রথম সফর।
রোববার দুপুরে ভুটানের রাজার বাংলাদেশ সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি জানান, বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ভুটানের রাজাকে স্বাগত জানাবেন। ভুটানের রাজার সফরে নতুন করে তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। সেগুলো হলো- ভুটানের থিম্পুতে একটি বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে ভুটানের জন্য বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ভোক্তা সুরক্ষায় প্রযুক্তিগত সহযোগিতা। এছাড়া সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতাসংক্রান্ত একটি চুক্তি আছে- সেটির নবায়ন করা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সফরের শুরুর দিন রাজা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন এবং জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। প্রথম দিন রাজার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ২৬ মার্চ ভোরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবেন রাজা।
মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ সফরে ভুটানের রাজা পদ্মা সেতু পরিদর্শন করবেন। তিনি শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করবেন। কুড়িগ্রামে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি পরিদর্শনের জন্য বিমানযোগে ঢাকা ত্যাগ করে তিনি সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়বেন। স্থলবন্দরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। সেখানে তাকে বিদায় জানাবেন নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
রাজার সফরের তাৎপর্য তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশে প্রথম কোনো উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর এটি। এ সফরে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে (বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে) ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। থিম্পুতে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা উদ্যোগের মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বৃহত্তর কল্যাণ সাধন হবে। ট্রানজিট এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির (পিটিএ) মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ হবে। বিদ্যুৎ খাতে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হবে।
তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এমবিবিএস কোর্সে ভুটানের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ আসন সংখ্যা ২২ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হবে। প্রতি বছর ভুটানের ফরেন সার্ভিস অফিসারদের জন্য বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য দুটি আসন বরাদ্দ করা হবে।
বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি ভুটানে একটি কূটনৈতিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় কারিগরি সহযোগিতা দেবে। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিলে ভুটানের কৃষিবিষয়ক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মেয়াদে তিন বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই সফর বাংলাদেশ-ভুটানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সুপ্রতিবেশীসুলভ পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান সুদৃঢ হবে।
বাংলাদেশে মহান স্বাধীনতার প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ ভুটান। মহান স্বাধীনতা মাসে দেশটির রাজার এ সফর এবং স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া ভুটানের রাজার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা যায়। সফরে ঢাকায় রাজাকে ব্যাপক উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হবে। রাজার আগমন উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে ভুটানের রাজা এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টানানো হয়েছে।
বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় চিকিৎসাধীন ভুটানি তরুণী : ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে কয়েক দফা সফল অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ভুটানি তরুণী কারমা দেমা (২৩)। ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ও রানি জেতসুন পেমা আগামীকাল (মঙ্গলবার) তাকে হাসাপতালে দেখতে যাবেন। এরপর রাজা ও চিকিৎসকদের গ্রিন সিগনাল পেলেই দেশে ফিরতে পারবেন ক্যানসার জয়ী কারমা দেমা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন নিজেই এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান। এবার বাংলাদেশ ভুটানের ক্যানসার আক্রান্ত একজন রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করল। দুই দেশের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে এবার ভুটানে বার্ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে দেবে বাংলাদেশ। এছাড়া দেশটির চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিতে আসতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক দশক আগে নাকের গহ্বরে ক্যানসার ধরা পড়ে ভুটানি তরুণী কারমা দেমার। নিজ দেশে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হওয়ায় ছুটে যান পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখানকার টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে কয়েক দফা চিকিৎসা নেন। এক পর্যায়ে নাকে পচন ধরা শুরু হলে চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়ে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। পরে ওই বিদেশি নাগরিককে দেশে এনে গত ১৪ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভুটান স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু ও এদেশের মানুষ ভুটানের প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভুটানকে উপহারস্বরূপ একটি বার্ন ইউনিট করে দিতে চাচ্ছেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভুটানের রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আমি ও দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি সমোঝতা স্মারক স্বাক্ষর করব। ওই স্মারকের আলোকে প্রাথমিক পর্যায়ে ভুটানে ২০ শয্যার একটি বার্ন হাসপাতাল করে দেওয়া হবে। যার সব ব্যয় বহন করবে বাংলাদেশ।