যেকোনো দুর্যোগে উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকবে কি না, তা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অনিশ্চয়তার মধ্যে সেখানে বসবাস করছে মানুষ।
শতবর্ষী স্থাপত্য ও সরু গলিপথ একদিকে যেমন পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বহন করছে, তেমনি ভূমিকম্পের মত বড় দুর্যোগ সেখানে বসবাসের ঝুঁকিও তৈরি করছে।
দেশে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পরের দিন আরও তিন দফা ভূমিকম্প পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়িয়েছে।
কয়েক দশকের মধ্যে ২১ নভেম্বর সবচেয়ে তীব্র এ ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দেওয়ার পরের কয়েকদিন পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে বাসিন্দাদের মধ্যে ভয়ের বিষয়টি আবার সামনে ফিরে এসেছে।
পুরান ঢাকার বিস্তৃত এলাকার মধ্যে বাংলাবাজার, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজা, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, লক্ষ্মীবাজার, কলতাবাজার, নারিন্দা, বাবুবাজার, আরমানীটোলাসহ বেশির ভাগই ঘনবসতিপূর্ণ। শতবর্ষী ভবনগুলো যেন একটি আরেকটির সঙ্গে লেগে আছে।
২২ নভেম্বর আরও তিন দফা ভূমিকম্পের পর বাসিন্দারাও বুঝতে পারছেন, মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূ-কম্পনে ভবনগুলোতে ঝুঁকি রয়েছে। যেকোনো সময় ঘটতে দুর্ঘটনা। আগের দিনের ভূমিকম্পে প্রথম প্রাণহানির খবরও এসেছে পুরান ঢাকা থেকেই। সেখানকার একটি ভবনের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তিনজনের।
এক সপ্তাহের মধ্যে আবার বৃহস্পতিবার বিকেলে মৃদু মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে দেশ। তার আগে গভীর রাতে দুটি ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য দিয়েছে ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমসিএস)।
পুরান ঢাকার অধিকাংশ গলিতে যানবাহন ঢোকার জন্য পর্যাপ্ত প্রশস্ততা নেই, শুধু মানুষের হাঁটা চলার জন্য ব্যবহৃত হয় এসব গলি। যেকোনো দুর্যোগে উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকবে কি না, তা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অনিশ্চয়তার মধ্যেই সেখানে বসবাস করছেন তারা।
মোহাম্মদ রোবায়েত হোসেন ৩৫ বছর ধরে আছেন নারিন্দা এলাকার বেগমগঞ্জ লেনে। তার ভাষ্য, এসব এলাকায় দুই দশক আগেও এত এত ভবন ছিল না। পুরনো ভবন ছিল। তবে গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে এত বাড়ি ওঠেনি আগে।
তিনি বলেন, “ব্যবসার সূত্রে দীর্ঘদিন এই এলাকাতেই থাকছি। এই দু’দশক ধরে এই এলাকায় কোনো ধরনের নিয়মকানুন ছাড়াই অপরিকল্পিত ভবন বাড়ছে। যার ফলে গলিগুলো শুধু মানুষ চলাচল করতে পারে আর যেগুলোকে আমরা রাস্তা বলি, সেখানে দুটো রিকশা পাশাপাশি পার হওয়াও কষ্টসাধ্য হয়।
“এজন্য কোনো বড় ধরনের দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করার কোনো উপায় দেখছি না।”
টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট বা ফাটলরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে বলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
আর ২১ নভেম্বরের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প যে ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে সেটির পর পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। এ ভূমিকম্পে আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকার একটি আট তলা ভবনের পাশের দেয়াল এবং কার্নিশ থেকে ইট ও পালেস্তারা খসে পড়ে তিনজন মারা যাওয়ার খবর বাসিন্দাদের মধ্যে আরও ভয় ছড়িয়েছে।
মঙ্গলবার পুরান ঢাকার কয়েকটি সড়কে এমন অনেক ভবন দেখা গেছে যেগুলোর ছাদ ও দেওয়াল থেকে নিয়মিত পলেস্তারা খসে নিচে পড়ছে। যেকোনো সময় কসাইটুলির মত দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা নিয়েই সেখানে বসবাসের কথা বলছেন বাসিন্দারা।
বংশাল এলাকার আবুল খয়রাত সড়কে (তারা মসজিদ) পুরনো বাড়ি রয়েছে এক সময়কার জমিদার সুবহানের, যেটি তার জন্মস্থানও। পরে সোবহানবাগে গিয়ে বাড়ি করলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা খয়রাত সড়কের পৈতৃক নিবাসটি প্রায় ২০০ বছর ধরে ব্যবহার করছেন। তাদের বংশের এক পরিবার এখনও ওই বাড়িতে থাকেন, যেটি সংস্কার আর মেরামতের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
বাড়িটি যেকোনো ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা এলাকাবাসীর। ভবনটির উল্টো দিকে নওয়াব সলিমুল্লাহর একটি ভবন রয়েছে। ঢাকার চতুর্থ এ নবাবের আত্মীয়রা সেখানে থাকতেন। ওই বাড়িটি এখনও রয়েছে, আর সেটি কোনো ধরনের সংস্কার ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাড়ির সামনে বসে ছিলেন এ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব সিরাজুল ইসলাম। বললেন, “আমার জন্মের পর থেকে এই বাড়ি দুইটা এমনই দেখতেছি। সুবহানবাগের বাড়িতে সুবহানের এক আত্মীয় থাকেন আর সলিমুল্লাহর এ বাড়ি এখন ভাড়া দেওয়া হয়।”
আতঙ্কে আরমানিটোলাবাসী
তীব্র ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার কসাইটুলিতে ২০/সি কেপি ঘোষ স্ট্রিটে বাংলা স্কুলের সামনে ২০ নম্বর ভবনের রেলিং ভেঙে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়।
ভবনটির নিচে মাংসের দোকান ও রেস্তোরাঁ পাশাপাশি। সব মিলিয়ে ভবনটির সামনে ওইদিন দুর্ঘটনার সময় অন্তত ৪০-৫০ জনের ভিড় ছিল। যেখানে মাংসের দোকানের কর্মচারীই ২০ জন।
মাংসের দোকানের কর্মচারী মো. সজল বলেন, “আমাদের দোকানে প্রতিদিনই বিক্রি বেশি হয়, কিন্তু শুক্রবার হওয়ায় কাস্টমার বেশি হয়েছে। তাও তো বেঁচে গেছি, উপরে বাসের ছাউনি দিয়ে তেরপল টানানো ছিল বলে। না হলে যেভাবে রেলিং পড়ছে, ২০-৩০ জন মারা যাইতো। আমাদের দোকানের একজনের হাত ভেঙেছে।”
এরপর রাজউকের পক্ষ থেকে দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় বেকার বসে আছেন মালিকসহ মাংসের দোকানের কয়েকজন কর্মচারী।
ওই বাড়ির ভেতরে ঢুকে মালিক বা দায়িত্বরত কাউকে পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করে একজন ভাড়াটিয়া বলেন, “যে দৃশ্য দেখেছি, তাতে গা শিহরে উঠেছিল। এখন প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকি, কখন কী হয়। আরওতো ভবন আছে, কোনো ভবনের তো রেলিং ভেঙে পড়েনি, এই ভবনের কাজ মনে হয় ভালো করেনি, যার কারণে রেলিং ভেঙে পড়েছে। আমরা এখান থেকে বাসা ছেড়ে দেব।”
সাততলা ভবনটি দেখে মনে হল খুব বেশি পুরনো নয়। তবে স্থানীয়রা বললেন, পুরনো বলে মনে না হলেও এটির বয়স প্রায় ১৮ বছর।
ভবনটি ধাপে ধাপে উপরে বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে তিনতলা পর্যন্ত করা হলেও পরে এক দুবছর পর পর উপরের একতলা দোতালা করে বাড়ানো হয়েছে। ভবনের উপরের অংশে চুনকামও দেখা যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী মো. নাজিম মিয়া বলেন, “পুরান ঢাকা সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ; আগুন লাগলেও ঝুঁকি, আবার ভূমিকম্পেও আতঙ্কের।
“তবে এই ভবনের রেলিং পড়ে লোকজন মারা যাওয়ার পর এলাকায় আতঙ্ক বেড়েছে, সবার মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে।”
জরাজীর্ণ আর ঝুঁকিপূর্ণ আর কত ভবন রয়েছে, সেখানকার বাসিন্দারা কী ভাবছেন বা কী করবেন তা জানতে আরও কটি এলাকায় ঢু মারলে চোখে পড়ে বেচারাম দেউরিতে হাজী নান্না বিরিয়ানীর দোকানের উল্টো পাশের প্রায় দুইশত বছরের পুরনো তিনতলা একটি ভবন। এটির অবস্থাও জরাজীর্ণ।
ওই বাড়িতে বসবাসকারীরা কেউ ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার বিষয়ে কথা বলতে চাননি। বাড়িটি কত পুরনো কিংবা কোন সময়ে তৈরি, তা নিয়েও তথ্য দিতে চাননি।
ওই এলাকার ৭৫ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা আহসান উল্লাহ বলেন, বাড়িটি একটি হিন্দু পরিবারের মালিকানাধীন। এখন যারা থাকছেন, তারা কোনো সংস্কার না করেই বসবাস করছেন।
“বাড়ির নিচে দেখেন হোটেল, মাংসের দোকানসহ বিভিন্ন দোকান। কোনো দুর্ঘটনা হলে বহু প্রাণহানি হবে। তাদের বলেও কোনো লাভ নেই। এমনিতেই আতঙ্কের মধ্যে আছি। কখন কী হয়।”
প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পর থেকে পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার স্থানীয় লোকজনও পরিবার নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
তাদের একজন শফিক মিয়া বলেন, “পুরান ঢাকায় যারা ভাড়াটিয়া আছেন তারা তো চাইলেই গ্রামে নিজেদের বাড়িতে যেতে পারছেন। কিন্তু আমরা যারা এখানকার স্থানীয় আছি, তাদের জন্য তো এটাই শেষ ঠিকানা। আমরা স্ত্রী, সন্তান, পরিবার নিয়ে খুবই অনিশ্চয়তায় আছি।
“বিশেষ করে বাসার শিশুরা ও মহিলাদের ভয় এখনও কাটেনি। আমাদের নিয়ে সরকারের বিশেষভাবে ভাবা উচিত।”
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “পুরান ঢাকার এখন যে অবস্থা সেটাতো দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার ফসল। সেখানে অধিকাংশ ভবনের তিন পাশেই অন্যান্য ভবন দিয়ে ঘেঁষা থাকে, শুধু সামনের অংশটা ফাঁকা সরু গলি থাকে। সেক্ষেত্রে কোনো দুর্ঘটনা মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। আর ঢুকলেও তারা সঠিক জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত। কারণ, প্রয়োজন অনুসারে তারা গাড়িটি ‘মুভমেন্ট’ করাতে পারবে না।”
বড় মাত্রার ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার পরিস্থিতি কেমন হবে- সেই বিষয়ে তিনি বলেন, “তখন তো একটি দুটি ভবনের কথা আসবে না। তখন একশ-দুইশ ভবনে উদ্ধার অভিযান চালাতে হতে পারে। আর আমাদের ফায়ার সার্ভিসের সেই সক্ষমতাও নেই। তারা একসাথে একটি কিংবা দুটো ভবন নিয়ে কাজ করতে পারে। তখন দেখা যাবে ওই এলাকা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।”
পুরান ঢাকার যেসব ভবন নতুন করে সংস্কার উপযোগী না, সেগুলোকে চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলতে হবে। আর যেসব ভবন সংস্কার করা যাবে সেগুলো দ্রুত সংস্কারের পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এই সভাপতি ।
ভূমিকম্প বা আগুনের মত জরুরি দুর্যোগের মতো পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী টিম প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ লাইন থেকে যেন আলাদাভাবে কোনো দুর্ঘটনার উদ্ভব না ঘটে, সেদিকটা নিয়ে কাজ করতে হবে।
দেশে ভূমিকম্প নিয়ে ঝুঁকির কথা অনেক দিন থেকে বলা হচ্ছে। এরপরও রাজধানী ঢাকায় বিশেষ করে পুরান ঢাকার পুরনো, ঝুঁকিপূর্ণ, নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা এবং অবৈধ ভবনগুলোর বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ভবন নির্মাণের সময় আইনকানুন মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)।
এ সংস্থার প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, “প্রথম হল ভূমিকম্পের পরে যে ভবনগুলো হেলে পড়ছে বা ফাটল ধরা পড়ছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করা। বিভিন্ন দিক থেকে ফোন আসছে বা আমাদের পরিদর্শক পরিদর্শন করে এগুলোকে আমরা চিহ্নিত করছি।
“এরপর আমরা বুয়েটের তত্ত্বাবধানে ভবন পরিদর্শনের বিষয়ে কর্মীদের একটা প্রশিক্ষণ দেব। প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা এটা চিহ্নিত করবে কোন ভবনটা ঝুঁকিপূর্ণ, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, কম ঝুঁকিপূর্ণ।”
বেশি ঝুঁকিপূর্ণগুলোকে নিয়ে বিস্তারিত যাচাইয়ের (ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট) পর সংস্কারযোগ্য হলে সেগুলোকে সংস্কার করার কথা বলেন তিনি।
আশরাফুল ইসলামের মতে, আর যদি সংশোধন করা না সম্ভব হয়, তাহলে তখন ভবন ভেঙে দিতে হবে।
“আবার কোনো কোনো জায়গায় হয়ত একটু প্লাস্টার বা জয়েন্টে একটু কলাম বা এক্সট্রা রড দিয়ে এটা ইঞ্জিনিয়ারিং সল্যুশন করা সম্ভব হবে।
“আরেকটা হল যে, আমাদের ঢাকা শহরে যত ভবন আছে বিশেষ করে আমরা ছয় তলার উপরে ভবনের অনুমোদন দেব না। আর সরু গলির রাস্তাগুলো প্রশস্ত করব।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এ বিষয়ক মহাপরিকল্পনা নিয়ে কোনো কাজ রাজউক করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা আপাতত ছয়তলার বেশি কোনো ভবন অনুমোদন দেব না। এবং যে ভবনগুলো আছে সেগুলো কোনটা কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ, ভেঙে ফেলা বা সরু গলি প্রশস্তকরণ নিয়ে আছি। আমাদেরও মহাপরিকল্পনা আছে, তবে সেটা এর মধ্যেই।”
পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে পরিকল্পনার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্থপতি ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আপাতত রাজউকের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে দক্ষিণ সিটি। রাজউকের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।
ভূমিকম্পে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলে উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর সক্ষমতা আছে কি না জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স) মামুনুর রশিদ বলেন, যদি বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে তাহলে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
“আমরা যদি তুরস্কের ভূমিকম্প দেখি, তুরস্কের ভূমিকম্পের সময় তো আমি গিয়েছিলাম। সেখানে ওই যে বড় ও ভারী সরঞ্জাম দিয়ে অপারেশন ছাড়া কিছু করার ছিল না। আর এই হালকা সরঞ্জাম দিয়ে সম্ভব না।”
তিনি বলেন, “যদি ছোটখাটো কিছু হয়, সেই ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা আছে। আমাদের হালকা সরঞ্জাম যেগুলো আছে, এগুলো দিয়ে আমরা কম ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার করতে পারবো। এগুলোর সক্ষমতা আছে, যদি বড় কিছু ঘটে যায়, এটা (ভূমিকম্প) যদি ৬ মাত্রার বেশি, ৭ মাত্রার বেশি হয় তখন তো বুঝতেই পারতেছেন।”
আতঙ্কে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরাও
ভূমিকম্পে আতঙ্কে আছেন পুরান ঢাকার বিভিন্ন মেসে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
গেন্ডারিয়ার নারিন্দায় একটি ছয়তলা ভবনে মেসে থাকেন রুদ্র বণিক। শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর থেকে এখনও ভয় কাটেনি তার।
তিনি বলেন, “এরকম ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি আগে কখনও হইনি। এই ভয়টা এখনও কাটেনি।
“ফেইসবুক স্ক্রল করলেই দেখি আমার বাসস্থান পুরান ঢাকা অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। কিছুক্ষণ পরপর মনে হয় চেয়ার নড়তেছে, বিছানা নড়তেছে; মনে হয় এই যেন আবার ভূকম্পন হচ্ছে। এখানে খুবই আতঙ্কে সময় পার করছি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও একমাত্র আবাসিক হল নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হলের ছাত্রী অঙ্কিতা সাহা বলেন, “শনিবারের ভূমিকম্পের পর পরই আমাদের সবাইকে হল থেকে বের করে বাংলাবাজার মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সকল ছাত্রীই ভয়ে ছিলাম। ভবনটি মনে হচ্ছিল ভেঙে পড়বে।
“এসব খবর শুনে বাড়ি যাওয়ার জন্য পরিবার থেকে চাপ আসছে। দুপুরে শুনলাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দিয়েছে, হলও ছেড়ে দিতে হবে।”
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন ভবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তা নির্ণয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেন। তারা জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনও জমা দেন। সেই প্রতিবেদনে চারটি ভবনকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেন তারা।
এর ১০ বছর পর ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দুই মাস সময় দিয়ে ভবনগুলো ভেঙে ফেলার জন্য চিঠি পাঠায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বিজ্ঞপ্তিতে শনাক্ত করা চার ও পাঁচতলার দুটি করে ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভবনগুলো আবার সংস্কারের প্দক্ষেপ নিলেও স্থায়ী কোনো সমাধানের দিকে এগোয়নি তারা।
চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারতলা ‘অবকাশ ভবন’ এর তৃতীয় তলার ছাদের রেলিংয়ের একটি অংশ ভেঙে পড়ে আহত হন প্রধান প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী শাকিল শিকদার।
ওই ভবনের নিচতলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যাফেটেরিয়া এবং দুই থেকে চারতলা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক, সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী ও সাংবাদিক সংগঠনের কার্যালয় রয়েছে।
এছাড়া ১১২ বছরের পুরনো প্রশাসনিক ভবনের পলেস্তারা ভেঙে তা বাহ্যিক মেরামত করেই চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।
একের পর এক ভূমিকম্পে এসব ভবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকতা-কর্মচারীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম বলেন, “আমরা আপাতত বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়ে ভাবছি। চারটি ভবন ভাঙার বিষয়ে এখনই কথা বলতে পারছি না।”





