ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান বলেছেন, করোনার ক্ষতি মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সবার আগে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য আগের কর্মসংস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি ব্যাপক হারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে ভোক্তার আয় বাড়বে। তারা উৎপাদিত পণ্য কিনবে। দেশের শিল্প, কৃষি ও সেবা খাত চাঙা হবে। টাকার হাতবদল দ্রুত হবে। এতে দ্রুত বাড়বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ছোট উদ্যোগে দিতে হবে প্রণোদনা। চলমান প্যাকেজগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা ঘোষণা করতে হবে। সম্প্রতি একান্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেছেন।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
আবুল কাসেম খান : অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আগামী বাজেটে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল থাকতে হবে। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতে। কারণ করোনা মহামারির ফলে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে এটি পরিষ্কার যে, এ খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
সরকারি-বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। নতুন হাসপাতাল, ওষুধ শিল্প, মেডিকেল যন্ত্রপাতিসহ নানা উপকরণ তৈরিতে বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলে এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে। সক্ষমতা বাড়বে। তখন এ ধরনের মাহামারি মোকাবিলা করা সহজ হবে।
করোনা মহামারির ফলে অর্থনীতিতে সৃষ্ট ক্ষতি মোকাবিলায় কোন খাতকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
আবুল কাসেম খান : দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখার পাশাপাশি আরও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। বর্তমান অনিশ্চয়তার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে আসবে না।
এ সময়ে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দিতে হবে। এর মধ্যে কর, ভ্যাট, সহজ শর্তে ঋণ, অবকাঠামো সহায়তা দিতে হবে। তাহলে অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসবেন। তখন শিল্প হবে, কর্মসংস্থান হবে। পণ্য কেনার সক্ষমতা বাড়বে। অর্থনীতিতে ভোক্তা ও পণ্যের জোগানের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি হবে। এর মাধ্যমে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে।
সরকার তো অনেক প্রণোদনা দিয়েছে। সেগুলোই তো পুরোপুরি এখনো কাজে লাগেনি।
আবুল কাসেম খান : প্রচলিত প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন আরও সহজ করতে হবে। সহজে ঋণ ছাড় করতে হবে। অনেকের ঋণের প্রয়োজন, কিন্তু তারা পাচ্ছে না। বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক, কুটির, ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না।
এদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এদেরকে টিকিয়ে রাখতে হবে। জামানত ছাড়া ঋণ দিতে হবে। ছোটরা টিকে না থাকলে অর্থনীতিতে ভারসাম্য আসবে না। তাদের জন্য যেমন সহজ শর্তে নতুন প্রণোদনা দরকার, তেমনি চলমান প্যাকেজগুলো আরও সহজ করতে হবে। ছোটরাই বড়দের অনেক পণ্যের জোগান দেয়।
করোনার মহামারি মোকাবিলায় বাজেটে কর কাঠামো কেমন হওয়া উচিত?
আবুল কাসেম খান : কর কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা উচিত। এ খাতে অনেক সমস্যা রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এগুলোর সমাধান করা উচিত। কর কাঠামো ও কর প্রদানে জটিলতাও প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না হওয়ার একটি কারণ।
বিধিবিধানের ম্যারপ্যাঁচের কারণে করপোরেট করে যা আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে হয়। এতে উদ্যোক্তাদের খরচ বেশি হচ্ছে। করপোরেট কর এখন সাড়ে ৩২ শতাংশ। কিন্তু গড়ে দিতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। অগ্রিম কর বাবদ যে অর্থ সরকারের হিসাবে দেওয়া হয়, সেগুলোকে চূড়ান্ত কর দায় হিসাবে গণ্য করা হয়। বছর শেষে হিসাবে প্রকৃত করের পরিমাণ কম হলেও এগুলো আর ফেরতও দেওয়া হয় না। আবার পরের বছরের করের সঙ্গে সমন্বয়ও করা হয় না।
এতে অনেক ক্ষেত্রে কর বেশি দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় কোম্পানি লোকসান দিয়েও কর দিচ্ছে। কেননা অগ্রিম যে কর দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আর পাওয়া যায় না। এ বৈষম্য দূর করতে হবে। এজন্য করের রেট কমাতে হবে। বিশেষ করে করোনার এ সময়ে এত বেশি কর দেওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বেশি কর দিলে একদিকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না, অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে।
তাই এ সময়ে করের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া জরুরি। এটিও হতে পারে এক ধরনের প্রণোদনা। কর দেওয়ার পর তা অডিট করা নিয়ে শুরু হয় নতুন হয়রানি। এসব কারণে অনেকে কর দিতে ভয় পায়। মানুষের মধ্যে করভীতি দূর করতে হবে।
কর খাতে সৃষ্টি জটিলতা নিরসনে আপনার প্রস্তাব কী?
আবুল কাসেম খান : ভালো অডিট ফার্মগুলোর একটি তালিকা করে দিতে পারে নীতিনির্ধারকরা। সেসব অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করে যে কর দেওয়া হবে তা কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে। তাহলে অডিট নিয়ে ঝামেলা হবে না। কোনো অডিট ফার্মের কর্মকাণ্ডে প্রশ্ন উঠলে তাদের বাদ দেওয়া যেতে পারে।
এতে করদাতাদের হয়রানি কমবে। হয়রানির ভয়ে অনেকে কর দেয় না। কর কাঠামোতে সংস্কার আনা জরুরি। এ ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা থাকতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা কর কাঠামো দেখে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কর জটিলতা নিরসনে কর আপিল ট্রাইব্যুনাল কী ভূমিকা রাখতে পারে?
আবুল কাসেম খান : কর আপিল আদালতে কর বিভাগের পাশাপাশি একজন নিরপেক্ষ নন ট্যাক্সবিষয়ক সদস্য থাকতে পারে। তাহলে সব পক্ষের কথা আদালতের বোঝার সুযোগ থাকবে। এটি স্বাধীন হতে হবে। তাহলে কর মামলা নিষ্পত্তি সহজ হবে। ন্যায়বিচার পাওয়ার গতি বাড়বে।
আপিল করতে গেলে বকেয়া করের একটি বড় অংশ পরিশোধ করতে হয়। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
আবুল কাসেম খান :আপিল করতে গেলে বকেয়া করের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আগাম পরিশোধ করতে হয়; এটি কমাতে হবে। মোট বকেয়ার ১০ শতাংশ জমা দিয়ে আপিল করার সুযোগ দিতে হবে।
তাছাড়া ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েও আপিল করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাহলে ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ বাড়বে। বর্তমানে বেশি কর দিয়ে আপিল করতে হয় বলে অনেকের পক্ষে করা সম্ভব হয় না।
ব্যবসায়ীদের পক্ষে সব সময়ই করপোরেট কর কমানোর দাবি করা হচ্ছে কেন?
আবুল কাসেম খান : দেশে করপোরেট কর অনেক বেশি। এটি কমালে ব্যবসা খরচ কমবে। আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হলে ব্যবসায়ীদের জন্য একটু সুযোগ হবে। বিভিন্ন খাতে কর প্রণোদনাও দেওয়া যেতে পারে।
যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কর্মীদের চাকরি দীর্ঘ সময় ধরে রাখে, নতুন কর্মসংস্থান সষ্টি করে, ভালো পণ্য তৈরি করে, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানকে ১ শতাংশ কর রিবেট দেওয়া যেতে পারে। এতে কর্মীবান্ধব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়বে। এটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যেতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগে মন্দা চলছে। বিনিয়োগ বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
আবুল কাসেম খান : যেসব আইন বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে সেগুলোর সংস্কার করতে হবে। ওয়ান স্পট সার্ভিসকে কার্যকর করতে হবে। ব্যবসা শুরুর জটিলতা নিরসন করতে হবে। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জটিলতা নিরসন করতে হবে। অন্যান্য বিধিবিধান বিনিয়োগবান্ধব হতে হবে। সব মিলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
আমদানি ও রপ্তানিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা যখন দেখবেন, এ দেশে সহজে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা পাবেন, তখনই তিনি এগিয়ে আসবেন।
করোনায় অর্থনীতিতে কোন কোন খাতে সমস্যা দেখছেন? এগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়?
আবুল কাসেম খান : করোনায় মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। খরচ কমে গেছে। মানুষ সঞ্চয়মুখী হয়েছে। এটি হচ্ছে অর্থনীতির বড় সমস্যা। মানুষ খরচ না করায় টাকার হাতবদল হচ্ছে না। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। টাকা ঘুরছে না। ব্যাংকে স্থির হয়ে আছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না। বর্তমানে সরবরাহ ঠিক আছে; কিন্তু চাহিদার দিকটি ঠিক নেই। চাহিদা বাড়াতে হবে।
বাড়াতে হবে ক্রয়ক্ষমতা। এজন্য ভোক্তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দিতে হবে। যারা কর দিচ্ছে তাদের ছাড় দিলে তারা বেশি খরচ করবেন। খরচ করতে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। ভোক্তা কমে গেলে চাহিদা কমে যাবে। তখন সরবরাহ ঠিক রাখা যাবে না। যারা বেশি খরচ করবেন, তাদের ১০ শতাংশ কর রেয়াত দিলে খরচ করতে উৎসাহিত হবেন। মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাতে হবে। যুক্তরাজ্যে করোনার ধাক্কা সামাল দিতে নিয়ম করা হয়েছে, যারা রেস্টুরেন্টে খাবে তাদের বিলে অর্ধেক ছাড় দেওয়া হবে। অর্ধেক টাকা সরকার ভর্তুকি হিসাবে রেস্টুরেন্টকে দেবে। বাংলাদেশে খরচ বাড়াতে এ রকম নানামুখী ছাড় দেওয়া যেতে পারে। এতে খাতভিত্তিক ব্যবসাগুলো চাঙা হবে।
ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
আবুল কাসেম খান : ছোটদের আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র নেই বলে তারা ঋণ পাচ্ছেন না। তাদের ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২ হাজার কোটি টাকার একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম প্রণয়ন করেছে। এর আওতায় ছোটদের ঋণ দেওয়া যায়। কিছু ঝুঁকি নিতে হবে। তবে বড়দের চেয়ে ছোটরা বেশি হারে ঋণ শোধ করে। ব্যাংক না পারলে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে।
টাকা পাচার বন্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়?
আবুল কাসেম খান : টাকা পাচার বন্ধ করতে হলে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। দেশের বাইরেও বিনিয়োগের সুযোগ দিতে হবে। তাহলে বিদেশের প্রযুক্তি দেশে আসবে। মুনাফা আসবে। মনিটরিং করতে হবে। বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এখন আর স্থানীয়ভাবে থাকার সুযোগ নেই। কোম্পানিগুলোকে গ্লোবাল করে গড়ে তুলতে হবে। এতে দেশের ব্র্যান্ডি হবে। বিদেশে দেশের সুনাম বাড়বে। ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে।
দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আবুল কাসেম খান : দেশের জনসংখ্যার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জনসংখ্যাই বড় সম্ভাবনা। এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কারিগর হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোক্তা বাড়াতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আমাদের জন্য অনেক বড় সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে।
করোনার এ ক্ষতি কাটিয়ে কবে নাগাদ দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে পারে?
আবুল কাসেম খান : এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে। ভ্যাকসিন দেওয়ার হার বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যে কোনো সময় তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। সে ব্যাপারে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ
আবুল কাসেম খান : ধন্যবাদ।