ভোটের ইস্যুতে বাড়ছে দেশি-বিদেশি চাপ

election-678ab9437becf

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স এরই মধ্যে পাঁচ মাস পার হয়ে গেছে। গঠিত হয়েছে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন। এরই মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা হয়েছে। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত এই সরকার কতদিন দায়িত্ব পালন করবে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে, কবে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা হবে-এ প্রশ্ন এখন সবার। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে না থাকা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিনিয়োগে মন্দা, প্রশাসনে অস্থিরতা, পরাজিত শক্তির নানা অপকৌশল-এসব কারণে সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার চাপ প্রবল হয়ে উঠেছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপ বাড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। তবে বহির্বিশ্বের চাপে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের দিন শেষ বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশির ভাগ দেশই সরকারের সংস্কারপদ্ধতির জোর সমর্থন দিচ্ছে। হাসিনা সরকারের দুর্নীতির বিষয়ে সরকারকে সমর্থন করে। তবে আন্তর্জাতিক মহল শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের কথা বলে। সংস্কার ইস্যুতে সরকারের সময় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বিদেশিরা। প্রয়োজনীয় সময়ের পক্ষেই ছিল তাদের অবস্থান। কিন্তু দুই মাস ধরেই সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলাপ-আলোচনা জোরালো হচ্ছে।

এদিকে, দেশের অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে চাপ বাড়ছে। বিএনপি ও তার মিত্র ছয়দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ, এলডিপি, ১২ দলীয় জোট, ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণফোরাম, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যসহ অন্তত ৪৮টি রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রার শুরুতে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানালেও এখন দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ চাইছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলেও মনে করছে এসব দল। একই মত ছয়দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটেরও। পাশাপাশি জামায়াত, গণ-অধিকার পরিষদ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টও (এনডিএম) দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছে।

রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে একের পর এক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন মহলের ষড়যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সাময়িক হিসাবেই সবাই বিবেচনা করছে। নির্বাচন দিতে দেরি হলে বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা বাড়বে এবং বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থনও কমে যেতে পারে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিদেশিরা তাদের নিজস্ব মতামত, নিজস্ব ধারণা দেবে। তাদের একেক রকম চিন্তাভাবনা, আমাদের বিচন্তাভাবনা হলো বাংলাদেশের জনগণের চিন্তাভাবনা। তিনি বলেন, আমরা তো প্রথম থেকেই বলে আসছি এই সরকার হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারে না। সরকার জনগণকে কথা দিয়েছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমতা নিয়েছে। অতএব যত দ্রুত নির্বাচন করতে পারে এবং জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে ততই এই সরকার এবং দেশের জন্য মঙ্গল। আমাদের মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) বিএনপির মতামত জানিয়েছেন, আগামী জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশনের সে প্রস্তুতি আছে। এটা সম্ভব। তাই আশা করি সরকার যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে একটি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে। এই স্বল্পকালীন সরকারের পক্ষে সংস্কার প্রস্তাবগুলো সব সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই যারা নির্বাচিত হবে তারা বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করবে এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ন্যূনতম সংস্কার করতে যেটুকু সময়, যৌক্তিক সে সময়টুকু নিয়ে সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। যৌক্তিক সময় যেটুকু লাগে সে সময়টুকু সরকারকে দেওয়া উচিত। তবে খুব লম্বা সময় দরকার নেই। তা হলে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের মতো হবে বলে আমরা মনে করি।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মার্কিন নির্বাচনে জো বাইডেনের দলের পরাজয়ের পর থেকে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের সঙ্গে ভারতের আলোচনা বাড়ে। এর আগে বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের প্রতি ভারতের আগ্রহই বেশি দেখা গেছে। শেখ হাসিনা ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও ওয়াশিংটন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা করেছে বলে জানান ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি। এছাড়া আঞ্চলিক দুই প্রভাবশালী দেশ ভারত, চীনসহ আরও কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদেশিদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আগ্রহের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর মন্তব্যে। গত সোমবার দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্পর্ক নিয়ে নির্বাচিত সরকারের সময় কথা হওয়া উচিত।’ যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার মতো তিনি যথাযথ লোক নন।

গত শনিবার কলকাতায় আমেরিকান সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটির বক্তব্যের দুদিন পর ভারতের সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা শুরু হয়। এরিক গারসেটি বলেন, বাংলাদেশে দ্রুত সময়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত আলোচনা করেছে। সম্প্রতি দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়, যেখানে বাংলাদেশে সম্ভাব্য নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। গত বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ডব্লিউআইওএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এরিক গারসেটি আবারও জানান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন চায়। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচন বাংলাদেশে নতুন অধ্যায় খুলতে সহায়ক হবে। মার্কিন এই কূটনীতিক বলেন, ‘আমরা উভয়ই (ভারত-যুক্তরাষ্ট্র) যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখতে চাই। আর এটি বাংলাদেশে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে সহায়তা করবে।’

এমন মন্তব্যের মাধ্যমে দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবারই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বললেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একক নীতিতে বিশ্বাস করে। সেটি হলো, উভয় দেশই শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া দেখতে চায়। এই মুহূর্তে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র।’

এদিকে নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে বিএনপিসহ অংশীজনদের কী অবস্থান, তা জানতে ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার রোববার বিএনপি ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। একই সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রদূত গত সোমবার বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন।

নির্বাচনে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশে কাজ শুরু করছে। ইউএনডিপির একটি প্রতিনিধি দল এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেছে। নির্বাচনে সহায়তা চেয়ে নির্বাচন কমিশন জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছিল, এটি জানিয়ে ঢাকায় সংস্থাটির আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে কী সহায়তা প্রয়োজন, তা মূল্যায়ন করা হবে। এ বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে ইউএনডিপি কী সহায়তা দিতে পারে, তা জানানো হবে। এছাড়া জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরের সময় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সেখানেও কারিগরি সহায়তার বিষয়টি উঠে আসে। ফলে বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা চাপ বিদেশিদের পক্ষ থেকে তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অবশ্য জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন মনে করেন, বহির্বিশ্বের চাপে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার দিন শেষ। এখানে আগে আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রে স্যাংশনের দিকে তাকিয়ে থাকত, নির্বাচনের আগে ভারত কী বলল সেদিকে তাকিয়ে থাকত। বাংলাদেশে এই দিন আর ফেরত আসবে না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অভ্যন্তরীণভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই এখানে নির্বাচন কবে হবে এবং কী ধরনের নির্বাচন হবে, কারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কী করবে না-এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। পৃথিবীর সব দেশেই নানা ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আছে। আমরা যেমন কারও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্পৃক্ত হই না, শুধুমাত্র মানবাধিকার ইস্যু বাদে। আমরা মনেও করি না যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এবং নির্বাচনিব্যবস্থায় কারও হস্তক্ষেপ দেশের মানুষ মেনে নেবে। কারণ এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ গণ-অভ্যুত্থান করেছে। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আমরা আর বাংলাদেশে দেখতে চাই না। এটি পরিবর্তনের জন্য আমরা লড়াই করব বলে মানুষকে কথা দিয়েছি। সুতরাং এটি আমরা করব।

Pin It