চাকরি জীবনের শুরু থেকেই নামে-বেনামে সম্পদ গড়তে বেপরোয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান। কর ফাঁকির সুবিধা দিয়ে দেশের নামি-দামি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের সঙ্গে ব্যবসায়িক কানেকশন গড়ে তোলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ট্রেড ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও সুকৌশলে কাস্টমস ক্যাডারে প্রবেশ, এলসি জালিয়াতি, বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য খোলা বাজারে বিক্রিসহ নানা অপকীর্তির বিস্তর অভিযোগ আছে। সব সরকারের আমলেই অবৈধ অর্থের প্রভাবে পেয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়। বাগিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং। রাজস্ব আয় বাড়ানোর গুরু দায়িত্বে থেকে সরকারকে রাজস্ববঞ্চিত করে গুছিয়েছেন নিজের আখের। কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের প্রায় সবই গড়েছেন স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে। সব মিলে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। কিনেছেন দামি গাড়ি, বাড়ি। এ কর্মকর্তা হাতে পরেন ৩১ লাখ টাকার বেশি দামের রোলেক্স ঘড়ি। তবে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতেই নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
এদিকে, চাকরি জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে অতিসম্প্রতি ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে গেছেন প্রভাবশালী এই সরকারি কর্মকর্তা। কুরবানির জন্য ১২ লাখ টাকায় ছেলের কেনা ছাগল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে বাবার পরিচয়ে টান পড়ে। এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে প্রথমপক্ষের স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর সঙ্গে আলোচনা করে পারিবারিক ড্রামা সাজান মতিউর। মিডিয়ার সামনে দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান মুশফিকুর রহমান ইফাতের সঙ্গে তার সম্পর্ক অস্বীকার করেন। এতে বাঁধে জট। বাবার অস্বীকৃতি পারিবারিক টানাপড়েন চরমে ওঠে। সন্তান ইফাত রাগ-অভিমানে চেষ্টা চালান আত্মহননের। এক পর্যায়ে পরিবারের সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলী, ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ও ইরফান দেশত্যাগ করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। বুধবার চট্টগ্রাম হয়ে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন তারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে এনবিআর সদস্য মো. মতিউর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।
জানা গেছে, ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল ট্রেড ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন মতিউর রহমান। এক পর্যায়ে ট্রেড ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হলে মতিউর অ্যাডমিন ক্যাডারে না গিয়ে কৌশলে যোগ দেন কাস্টমস ক্যাডারে। এর আগে ১৯৯০-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পল্লী কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) চাকরি করেন তিনি। বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আব্দুল হাকিম হাওলাদারের ছেলে মতিউর কাস্টমসে যোগ দিয়েই অর্থ-সম্পদের লোভে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ আছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের দিকে সেগুনবাগিচায় কাস্টমস বন্ড অফিসে যোগ দেন মতিউর। সেখানে কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাকে বদলি করা হয় টেকনাফে। বদলির ছয় মাসের মধ্যেই তৎকালীন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলে (যার নামের আদ্যাক্ষর ‘ব’) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে ঢাকার শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগে পোস্টিং বাগিয়ে নেন। দীর্ঘদিন এখানে দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালের শেষ দিকে তিনি বদলি হন চট্টগ্রাম বন্দর হাউজে।
ব্যবসার নেটওয়ার্ক : সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস হাউজে বসার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তৎকালীন সময়ে তার সঙ্গে জোট আমলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, সেই মন্ত্রীর ছেলে, একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের এমডি, জনৈক করিম নামের ব্যবসায়ীসহ পুরান ঢাকার বেশ কিছু আমদানিকারকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক কানেকশন তৈরি করেন মতিউর। ব্যবসায়ী গ্রুপের এমডি এবং জনৈক করিমের সঙ্গে এখনো তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক অটুট। চুক্তিপত্র দলিলের মাধ্যমে এদের কাছে তার কয়েক হাজার কোটি টাকা লগ্নি করা আছে। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে একটি কোম্পানি বেশ আলোচিত ছিল। সেই মন্ত্রীর ছেলে, একটি ভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও তার জামাতার যৌথ অংশীদারত্বে এই কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন মতিউর। সরকারি চাকরির কারণে মেমোরেন্ডামে মতিউর তার নামের পরিবর্তে রাজ্জাক নামের একজনকে কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। ভাই কাইয়ুমের চেয়েও এই রাজ্জাক তার অবৈধ আয়ের বড় রক্ষক। রাজ্জাক ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে মতিউরের অবৈধ আয়ের বিপুল টাকা লেনদেন হয় বলে পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিএফআইইউ খোঁজ নিলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে বলে দাবি করেছে সূত্রটি।
সব আমলেই দোর্দণ্ড প্রতাপ : বিএনপি, আওয়ামী লীগ এমনকি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এনবিআরে প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করেছেন মতিউর। ১/১১ এর তত্ত্বাবধায়ক আমলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়েরসহ মতিউরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়। এরপর প্রভাবশালী বিভিন্ন মহল থেকে মতিউরকে রক্ষায় তদবির শুরু হয়। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক উপদেষ্টাও তার পক্ষে শক্ত তদবির করেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট সরকার গঠনের পর মতিউর এক মন্ত্রীর একান্ত সচিবের চেয়ারে বসেন। কয়েক মাস দায়িত্ব পালনের মাথায় ছাত্র জীবনে মতিউরের শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে হৈচৈ শুরু হয়। তখন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনের ফলে তাকে ওই মন্ত্রীর একান্ত সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বন্ড সুবিধায় চোরাকারবার : অভিযোগ আছে, বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে মোটা টাকা হাতিয়ে নিতেন মতিউর। টাকার লোভে এই চোরাকারবারে নিজেকে সরাসরি জড়িত করেন তিনি। আর কারবার নির্বিঘ্ন করতে ২০১৩ সালের দিকে পুরোনো ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের আশ্ররাফাবাদ লোহারপুল সংলগ্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন এস কে থ্রেড নামে সুতার কারখানা। এটারও মালিকানা ভাই এমএ কাইয়ুম হাওলাদারের নামে। কার্যত শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা সুতা খোলাবাজারে বিক্রি নির্বিঘ্ন করতেই এই কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। কারখানায় উৎপাদিত সুতার আড়ালে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা সুতা বছরের পর বছর ধরে বিক্রির মাধ্যমে সরকারকে রাজস্ববঞ্চিত করা হচ্ছে। তৎকালীন সময়েই কারখানাটি তৈরিতে দুই কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। শুক্রবার সরেজমিন কারখানাটি বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানাটিতে ৫০-৬০ জন শ্রমিক কাজ করে। এখানে সুতা উৎপাদন ও রং করা হয়। ঈদের ছুটির কারণে এটা বন্ধ।
গার্মেন্টকর্মী থেকে শিল্পপতি : পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমানের ভাই একসময় গার্মেন্টকর্মী হিসাবে চাকরি করতেন। মতিউরের অবৈধ আয়লব্ধ সম্পদের বেশির ভাগই রয়েছে কাইয়ুমের নামে। ফলে গার্মেন্টকর্মী থেকে সরাসরি শিল্পপতি বনে গেছেন তিনি। টঙ্গীর রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান এসকে ট্রিম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইয়ুম। কামরাঙ্গীরচরে এসকে থ্রেড নামের সুতা উৎপাদন কারখানার মালিকও তিনি। ভালুকা ও বরিশালে প্রতিষ্ঠিত গ্লোবাল সুজ লিমিটেডের অংশীদারত্ব আছে তার। এছাড়াও ঢাকায় বেশ কয়েকটি এপার্টমেন্টসহ কাইয়ুমের নামে স্থাবর-অস্থাবর আরও বিপুল সম্পদ রয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মীর নামের আদ্যাক্ষর ‘এস’ এবং কাইয়ুমের নামের আদ্যাক্ষর ‘কে’ মিলিয়ে এসকে ট্রিম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং এসকে থ্রেড কারখানার নামকরণ করা হয়েছে। জানা গেছে, মতিউরের ভাইয়ের স্ত্রী কুলসুমের নামে বন্ড লাইসেন্স আছে। এই লাইসেন্সে ব্যবসা পরিচালনাকারী একজনের কোম্পানিতে ২৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কল্যাণপুরের বিআরটিসি বাসডিপো সংলগ্ন এলাকায় একটি সিএনজি স্টেশনের ২০ শতাংশ শেয়ারও কেনা আছে কাইয়ুমের নামে। মতিউরের কল্যাণে আরেক ভাই নূরুল হুদা বেকার হওয়া সত্ত্বেও কোটিপতি বনে গেছেন। ফার্মগেটের অর্কিট প্লাজায় অবস্থিত সাইমুম অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড এবং অপর একটি গার্মেন্টে তার নামে শেয়ার রয়েছে।
জমজমাট পারিবারিক ড্রামা : জানা গেছে, ছাগলকাণ্ডে মতিউর রহমানের পারিবারিক ড্রামা জমে উঠেছে। ছাগল নিয়ে ইফাতের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের চাপে তারই সাজানো স্ক্রিপ্ট নিয়ে মিডিয়ার সামনে আসেন মতিউর। পারিবারিক কলহের কারণে দুপক্ষের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পর্ক সুখকর নয়। এই সুযোগে লায়লা তার স্বামীকে বোঝাতে সক্ষম হন ইফাতের কারণেই তাদের আজ এ অবস্থা। তাই ইফাতের পরিচয় ও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করলে সব ঝামেলা চুকে যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ছেলের স্বীকৃতি অস্বীকার করে বাবা। এরপর ঘরে-বাইরে তুমুল চাপে পড়েন মতিউর। সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ফেসবুকে মতিউরকে চরম স্বার্থপর আখ্যা দিয়ে ট্রল চলতে থাকে। আর ঘরে রাগ-অভিমানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ইফাত। এরপর ইফাতের বোন মাধবী ও মা শাম্মী মতিউরের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুরো ঘটনা অবহিত করেন। তখন পারিবারিকভাবে আলোচনা করে ইফাতকে মাদকাসক্ত, উচ্ছৃঙ্খল হিসাবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করতে স্ক্রিপ্ট সাজানো হয়। সেখানে ইফাতকে অনেক আগেই ত্যাজ্য করার ঘোষণা ছিল। কিন্তু ইফাতের আপত্তির মুখে সেটাও সফল হয়নি। এক পর্যায়ে ইফাত ও ইরফানকে নিয়ে দেশ ছাড়েন মা শাম্মী।