করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক উদ্বেগজনক মোড় নিলেও আমদনি ব্যয় কম থাকায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার খানিকটা ‘স্বস্তিদায়ক’ অবস্থায় আছে।
বুধবার দিনের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৬৬ কোটি (৩২ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন) ডলার।
প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে আট মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
কঠিন সময়ে রিজার্ভের এই স্বস্তিকে ‘মন্দের ভালো’ হিসাবে দেখছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “পুরো বিশ্ব এখন অবরুদ্ধ। কোভিড-১৯ এর কারণে স্থবির হয়ে আছে অর্থনীতির চাকা। রেমিটেন্স-রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছে। তারপরও প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ একটা স্বস্তির জায়গা তো বটেই।”
আমদনি ব্যয় কমার কারণে রিজার্ভে সেভাবে এখনও চাপ পড়েনি জানিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, “এখন অন্য সব পণ্য আমদানি হচ্ছে না বললেই চলে। যে জ্বালানি তেল আমদানি হচ্ছে তার দামও ব্যারেলে ২০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে রিজার্ভের উপর চাপ কম পড়ছে।”
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ সংকট কেটে যেতে শুরু করলে আমদানি খরচ বাড়বে। তখন এই রিজার্ভ কাজে দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৭ সালের ২২ জুন রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। মাস দুয়েকের মধ্যে তা আরও বেড়ে ৩৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ওটাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। আড়াই বছর পর গত ১ মার্চ সেই রিজার্ভ ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। মাঝের এই আড়াই বছরে রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৫০ থেকে ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন বুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় সাড়ে ৬ শতাংশের মত কমেছে। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ।
চলতি এপ্রিল মাসের ১৫ দিনে (১ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল) পোশাক রপ্তানি কমেছে ৮৫ শতাংশের মতো। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকলে মার্চ মাসে রেমিটেন্স কমেছে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এপ্রিল মাসের তথ্য আরও করুণ। মাসের আট দিনে (১ এপ্রিল থেকে ৮ এপ্রিল) মাত্র ২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের এই আট দিনে এসেছি ৪৩ কোটি ডলার; দ্বিগুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের আমদানি সংক্রান্ত আট মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ৫ শতাংশের মত।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
সর্বশেষ গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আকুর বিল (প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার) পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের আকুর বিল পরিশোধ করতে হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।
তার আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ মজুদ থাকতে হয়।
এদিকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবারও ১৫ মিলিয়ন ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল) ৬৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ছাইদুর রহমান বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। অনেক ব্যাংকের হাতে থাকা ডলার দিয়ে এলসির দায় পরিশোধ করা যাচ্ছে না। চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এখন ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।