মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি হয়ে উঠেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সেই জীবন সাগরের ঢেউয়ে চেপে বাঙালি পৌঁছেছে স্বাধীনতার বন্দরে। শাসকের দমন-পীড়ন রুখতে পারেনি টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট ‘খোকা’র পথ; তার নেতৃত্বের ইন্দ্রজালে আটকা পড়েছে মহাকাল। তিনি বঙ্গবন্ধু, তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকের বুলেট তার রক্ত ঝরিয়েছে, বাঙালির জীবন থেকে সেই মহাজীবনের ছায়া কি কেড়ে নিতে পেরেছে ?
১৯২০
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা শেখ সায়েরা খাতুন। ৪ কন্যা এবং ২ পুত্রসন্তানের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। মা-বাবা তাঁকে ‘খোকা’ বলে ডাকতেন।
১৯২৭
সাত বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে তাঁর স্কুল জীবন আরম্ভ করেন। নয় বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে ওঠার আগে অন্য আরো দশজন কিশোরের মত শেখ মুজিবুর রহমান খেলার মাঠকেই বেশি ভালোবাসতেন। ফুটবল খেলার প্রতি ছিল তাঁর দুরন্ত টান। একজন মেধাবী ফুটবলার হিসেবে কৈশোরে কুড়িয়েছিলেন অসামান্য খ্যাতি। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলাগুলোতে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মিত পুরস্কৃত হতেন।
১৯৩২/১৯৩৩
শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ বছর বয়সে শেখ ফজিলাতুন্নেসা (রেনু)-কে বিয়ে করেন। তাঁরা দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল এর জনক-জননী ছিলেন।
১৯৪২
শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই বছরে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকেই স্নাতক শেষ করেন।
১৯৪৩
শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন পর্যন্ত তিনি তাঁর দায়িত্ব প্রশংসার সাথে পালন করেন।
১৯৪৬
শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট কুখ্যাত ‘ক্যালকাটা কিলিং’ (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শান্তি বজায় রাখার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দাঙ্গায় তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষদের জীবন রক্ষা করেন।
১৯৪৭
ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। যদিও এই উদ্যোগ বাতিল হয়। কিন্তু পরে এটিই একজন জাতির পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি হয়ে ওঠে। অন্যান্যদের মত ভারত ভাগের পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান তড়িঘড়ি করে পূর্ব বঙ্গে আসেননি, বরং কয়েক সপ্তাহ তিনি কলকাতায় ছিলেন, রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মহাত্মা গান্ধীর শান্তি মিশনে যোগ দেন।
১৯৪৮
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে মেনে নিতে হবে।” শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানান। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের প্রস্তুতি ও কর্মতৎপরতা শুরু করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালনের সময়ে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন সহকর্মীসহ গ্রেপ্তার হন। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৪৯
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা বিধান এবং অধিকার আদায় আন্দোলন সমর্থন জানান। ১৯ এপ্রিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে মিছিল বের করার প্রস্তুতির সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাচার্যের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারাগারের বন্দি থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫২
২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন, “একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’’ কারাগারে বন্দি অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন। আন্দোলনকে সফল করতে কারাগার থেকেই পাঠাতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারেই টানা ১১ দিন ধরে আমরণ অনশন চালান এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট আহ্বান করে। আন্দোলনরত ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক,সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ আরও অনেকে। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানান। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দেন, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে যান বৈশ্বিক অঙ্গনে।
১৯৫৩
শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং একজন বাঙালি নেতা হিসেবে তার উত্থান হয়।
১৯৫৪
১০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগ একাই ১৪৩ টি আসনে জেতে। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৫ মে নতুন প্রাদেশিক সরকারের সমবায় ও কৃষি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ৩০ মে ভারত স্বাধীনতা আইন- ১৯৪৭, প্রয়োগ করে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে ঢাকায় পা ফেলামাত্রই গ্রেপ্তার হন। ২৩ ডিসেম্বর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৫৫
সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সব ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তি এবং অংশ নেওয়া নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নাম রাখা হয় ‘আওয়ামী লীগ’। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৬
খান আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকারে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। মাত্র নয় মাস তিনি মন্ত্রী পদের দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাঙালির অধিকার আদায় আন্দোলনকে বেগবান করা এবং সংগঠনকে আরও সুসংহত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫৭
১৯৫৭ সালের ১৩-১৪ জুন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।২৪ জুন থেকে জুলাইয়ের ১৩ তারিখ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি সফরে চীনে যান।
১৯৫৮
৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। ১১ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁকে হয়রানি করা হয়। ১৪ মাস পরে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেটেই গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬১
হাইকোর্ট শেখ মুজিবুর রহমানের আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করার পর শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি পান। এ সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উদ্যমী ছাত্র নেতাদের নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬২
আইয়ুব সরকার ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে। ২ জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ জুন শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর যান এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধীদলকে সাথে নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেন।
১৯৬৪
২৫ জানুয়ারি জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির ৩২নং বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই অধিবেশনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে আলাদা হয়ে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৬-৮ মার্চ কাউন্সিল মিটিং-এ দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। দাঙ্গার পর শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সেনাশাসক আইয়ুব খান বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল বা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬৫
পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ‘তথাকথিত’ আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং পরে হাইকোর্টের আদেশে তিনি মুক্তি পান।
১৯৬৬
শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এই ছয় দফা মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজ বুনে দেয়, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ায় আঘাত করে। ১৮-২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিংয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে আটবার গ্রেপ্তার করা হয়। সবশেষ ৮ মে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় তিন বছর শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ ছিলেন।
১৯৬৮
৩ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার মোট ৩৫ জন বাঙালির (রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, সরকারি অফিসার) বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেই ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের উপর পুণরায় গ্রেপ্তারের আদেশ জারি করা হয়। ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১ নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা দায়ের করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকাজ শুরু হয়।
১৯৬৯
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র গণআন্দোলন শুরু হয়। টানা গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭০
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার আলোকে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি নৌকা প্রতীক বেছে নেন। ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত অঞ্চলে ছুটে যান। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তান অংশে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে (সংরক্ষিত ১০ টি নারী আসনসহ) আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ।
১৯৭১
১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর মাত্র দুই দিন আগে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার ফলে সর্বস্তরের বাঙালি জনতা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নতুন মোড় নেয়। ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু কার্যত ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান। একদিকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অপর দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে যেত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ। বাংলার মানুষ মেনে চলতেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। এইরকম উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ১৬ -২৪ মার্চ পর্যন্ত দফায় দফায় এই আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু কোন ফলপ্রসূ সমাধান আসেনি। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির উপর পাক হানাদার বাহিনী শতাব্দীর অন্যতম ঘৃণ্য গণহত্যা চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং গণপরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (বর্তমানে মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। অগাস্ট এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার করে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা দাবি করেন। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়।
১৯৭২
৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সেদিনই তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন যাত্রা করেন। লন্ডনে হোটেলে অবস্থানকালে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব মিডিয়ার মুখোমুখি হন। ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে দেখা করেন। ঢাকায় ফেরার পূর্বে তিনি নয়াদিল্লীতে কিছুসময় অবস্থান করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিমান বন্দরে সাদর অভ্যর্থনা জানান। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসেন। সেদিন বাঙালি জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জানায়। লক্ষ জনতার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় স্নাত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে আসেন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির উপর স্থাপন করেন। এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর পুনর্বাসন, স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠানো, দশ মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, একশোরও বেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘ, ন্যাম, ওআইসি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ইত্যাদি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
১৯৭৩
নব প্রণীত সংবিধানের আলোকে, ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩ টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। ২৩ মে বিশ্ব শান্তিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে “জুলিও কুরি” পুরস্কারে ভূষিত করে। ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আলজেরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আলজেরিয়ায় বিশ্বনেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৪
২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯ তম সাধারণ পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তব্য দেন। এর মাত্র সাতদিন আগে, ১৭ সেপ্টেম্বর, বিশ্ববাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে ১৩৬ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়।
১৯৭৫
১৫ অগাস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্ধকারতম দিন। বাঙালি জাতি এই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে এবং সাথে সাথে স্মরণ করে বিশাল হৃদয়ের সেই মহাপ্রাণ মানুষটিকে যিনি তার সাহস, শৌর্য, আদর্শের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালি জাতির অন্তরে।
জিজিএনটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।