মহামারী শেষে অর্থনীতিকে তুলতে ৪ কাজ, বাস্তবায়ন ৩ পর্যায়ে

Untitled-6-samakal-5e946ce1ea247

বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় চারটি মূল কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার, যা বাস্তবায়িত হবে তিনটি পর্যায়ে।

মহামারী রোধে গোটা দেশের মানুষের ঘরবন্দি অবস্থার মধ্যে সোমবার বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে এই পরিকল্পনা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার কথাও জানান তিনি, যা দেশের জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

বৈশ্বিক মহামারী রূপ ধারণ করা করোনাভাইরাস বাংলাদেশেও সংক্রমিত হওয়ার পর গত ২৫ মার্চ জারি উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

এই কার্যক্রমে অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন খাতের জন্য নানা প্রণোদনা প্যাকেজও ঘোষণা করেন তিনি, সেই প্যাকেজও বাড়ছে।

রোববারের ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা আমাদের অর্থনীতির জন্য দুঃচিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি না, এই সঙ্কট কতদিন থাকবে এবং তা আমাদের অর্থনীতিকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

“তবুও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি, যা জিডিপি’র ৩.৩ শতাংশ।”

অর্থনীতির উত্তরণে চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “যা অবিলম্বে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট তিন মাসে, স্বল্প-মেয়াদে আগামী অর্থবছরে এবং মধ্য মেয়াদে পরবর্তী তিন অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা হবে।”

৪ কার্যক্রম

>> সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা: সরকরি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

>> আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখা হল আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য।

>> সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি: দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হবে।

> মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা: অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মুদ্রা সরবরাহ এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে।

রোগ প্রতিরোধ করতে গিয়ে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ার কথা বলেন শেখ হাসিনা।

“বাংলাদেশেও গত ২৫-এ মার্চ থেকে ২৫-এ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা ৩২ দিন সাধারণ ছুটি বলবৎ হয়েছে। জরুরি সেবা কার্যক্রম ছাড়া সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আজ দেশের সিংহভাগ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ছোট-খাটো কারখানা বন্ধ। গণপরিবহন ও বিমান চলাচল স্থগিত।”

এই পরিস্থিতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সুরক্ষায় নেওয়া কর্মসূচিও তুলে ধরেন সরকার প্রধান।

কর্মসূচিগুলো

>> স্বল্প-আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করার জন্য ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ১ লাখ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মোট মূল্য ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা।

>> দিনমজুর, রিক্সা বা ভ্যান চালক, মটর শ্রমিক, নির্মাণ শ্র্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্র্রমিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ যাঁরা দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লক-ডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা ব্যাংক হিসাবসহ দ্রুত তৈরির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।এই তালিকা প্রণয়ন সম্পন্ন হলে এককালীন নগদ অর্থ সরাসরি তাদের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হবে।এখাতে ৭৬০ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে।

>> সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত ‘বয়স্ক ভাতা’ ও ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’ কর্মসূচির আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা হবে। বাজেটে এর জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৮১৫ কোটি টাকা।

>> জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত অন্যতম কার্যক্রম গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এ বাবদ সর্বমোট ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কেউ গৃহহীন থাকবেন না।

>> শিল্পখাতে আর্থিক প্যাকেজ: ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, অতি-ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা,এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড-ইডিএফ-এর সুবিধা বাড়ানোর জন্য ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা,প্রি শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স এর আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকা এবং রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য বিশেষ তহবিল বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা।

জমি ফেলে না রাখার আহ্বান

শিল্পোৎপাদনে করোনাভাইরাস মহামারীর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা কৃষি উৎপাদন দিয়ে কাটিয়ে উঠতে চাষাবাদ বাড়ানোর আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “এই দুঃসময়ে আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু সচল রাখা নয়, আরও জোরদার করতে হবে।

“সামনের দিনগুলোতে যাতে কোনো প্রকার খাদ্য সঙ্কট না হয়, সেজন্য আমাদের একখণ্ড জমিও ফেলে রাখা চলবে না।’

এজন্য কৃষি-সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বীজ, সার, কীটনাশকসহ সকল ধরনের কৃষি উপকরণের ঘাটতি যাতে না হয় এবং সময়মত কৃষকের হাতে পৌঁছে -সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, কৃষকেরা যাতে উৎপাদিত বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য চলতি মওসুমে গত বছরের চেয়ে ২ লাখ মেট্রিক টন অতিরিক্ত ধান ক্রয় করা হবে। এজন্য অতিরিক্ত ৮৬০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ তহবিল হতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীদের কৃষি, মৎস্য, ডেইরি এবং পোল্ট্রি খাতে ৪ শতাংশ সুদহারে ঋণ প্রদান করা হবে।

কৃষি ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথাও বলেন তিনি।

দেশে বর্তমানে খাদ্য সঙ্কট নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আল্লাহর রহমতে গত মওসুমে আমাদের রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মওসুমে বোরো ধানেরও ভালো ফলন হওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।”

Pin It