মহারাষ্ট্রে অবশ্যই সরকার গড়বে, অন্যদের সমর্থন নিয়ে হয়তো হরিয়ানাতেও, কিন্তু সত্য হলো, দুই রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বড় ধাক্কা খেল নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের বিজেপি। বেলা দুটো পর্যন্ত ভোট গণনার যা ইঙ্গিত, তাতে স্পষ্ট ছোট গল্পের মতো ‘শেষ’ হয়েও শেষ হলো না ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও শরদ পাওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)।
একই সঙ্গে এটাও বলা জরুরি, প্রায় সব বুথ ফেরত সমীক্ষায় এই দুই রাজ্যে যেভাবে আরও একবার বিজেপির হেলায় সরকার গঠনের ছবি আঁকা হয়েছিল, শাসক দল তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। তুলনায় একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া কংগ্রেস ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংস স্তূপ থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে উঁচু মাথা আরও উঁচু হয়েছে মারাঠা নেতা শরদ পাওয়ারের।
মহারাষ্ট্রে বিধানসভার মোট আসন ২৮৮। পাঁচ বছর আগে বিজেপি-শিব সেনা জোট পেয়েছিল ১৮৫ আসন। মোকাবিলায় কংগ্রেস-এনসিপির প্রাপ্তি ছিল ৮৩। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর প্রবল উপস্থিতি এবং রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবিশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কাছে কংগ্রেস-এনসিপিকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। শরদ পাওয়ার ও তাঁর দলের অন্য বড় নেতা প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে ভোটের আগে দুর্নীতির মারাত্মক অভিযোগ আনা হয়। তদন্তকারী দল পাওয়ারকে গ্রেপ্তার করার সমনও জারি হয়। দুই দলের বড় নেতাদের ভাঙাতে উঠেপড়ে নামে বিজেপি। সফলও হয়। প্রচারে সর্বস্ব নিয়োগ করেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে, গতবার যতগুলো আসন বিজেপি ও শিবসেনা জিতেছিল, এবার তা থেকে অন্তত ২৫টা আসন তারা কম পেতে চলেছে। তার চেয়েও বড় কথা, বুথ ফেরত সমীক্ষা যেখানে শাসক দলের প্রায় আড়াই শ আসন প্রাপ্তির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, দৌড় শেষ হতে চলেছে তার অনেক আগেই। শুধু তাই নয়, বিজেপি এক শর গণ্ডি পেরোতে পারবে কি না, সেই সংশয়ও প্রবল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেবেন্দ্র ফডনবিশ নিশ্চিতই এই প্রথম আরও একবার শপথ নেবেন। কিন্তু সেই গৌরবে কালির ছিটে থাকছে।
হরিয়ানার ছবিটা শাসক দলের পক্ষে আরও করুণ।) ৯০ আসন বিশিষ্ট বিধানসভায় পাঁচ বছর আগে বিজেপি জিতেছিল ৪৭ আসন। এবার তাদের স্লোগান ছিল, ‘অব কি বার পঁচাত্তর পার’। এই বছরের মে-জুন মাসে লোকসভার ভোটে বিজেপি রাজ্যের দশটি আসনই জিতেছিল। ওই নির্বাচনে ৯০ বিধানসভা আসনের মধ্যে ৭৯টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। বৃহস্পতিবার বেলা দুটো পর্যন্ত গণনার যা ট্রেন্ড, তা বিজেপির পক্ষে নিতান্তই হতাশজনক। একার পক্ষে ফের সরকারে আসা তো দূরের কথা, শরিক শিরোমণি অকালি দলকে নিয়েও সেই স্বপ্ন পূরণ প্রায় অসম্ভব। এই রাজ্যে কংগ্রেস তার হেঁটমুন্ড অবশ্যই তুলে ধরেছে, সেই সঙ্গে মাথা উঁচু হয়েছে জননায়ক জনতা পার্টির (জেজেপি) দুষ্মন্ত চৌটালার। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দেবী লালের পুত্র ওম প্রকাশ চৌটালার নাতি ৩১ বছরের এই রাজনীতিক ভারতীয় লোক দল ভেঙে কয়েক মাস আগে নিজের দল জেজেপি তৈরি করেন। গণনার গতি প্রকৃতি একই রকম থাকলে ১০টির মতো আসন জিতে তিনিই হতে চলেছেন ‘কিং মেকার’। বিজেপি ও কংগ্রেস দুই দলই ইতিমধ্যেই তাঁর সমর্থন পেতে সচেষ্ট। দুষ্মন্ত বলেছেন, দিল্লি এসে দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর দল সিদ্ধান্ত নেবে।
রাজ্য বিধানসভার ভোট হলেও দুই রাজ্যে প্রচারে বিজেপির সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল জাতীয়তাবাদ।) যে-অস্ত্রে শান দিয়ে বিজেপি ২০১৯ লোকসভা ভোটে ৩০৩ আসন পেয়েছিল, এবারেও সেই অস্ত্র তারা হাতে তুলে নেয়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, পাকিস্তানকে জাতিসংঘে কোণঠাসা করা, ভোটের ঠিক আগে নিয়ন্ত্রণরেখার অন্য ধারে সন্ত্রাসবাদী শিবির ধ্বংস, মোদির ভাবমূর্তি এবং বিরোধীদের ‘দুর্নীতির’ ছবি তুলে ধরে বিজেপি মহারাষ্ট্রে ২৫০ আসন পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। তারা ভাবতেও পারেনি, সব দিক থেকে দুর্বল এনসিপি ও দুর্বলতর কংগ্রেস বেকারত্ব, বেহাল অর্থনীতি, কৃষি বঞ্চনা এবং সামাজিক অসন্তোষকে হাতিয়ার করে এভাবে মাথা তুলে ১০০ আসন জেতার মতো জায়গায় পৌঁছাবে। সোনিয়া গান্ধী একদিনের জন্যও প্রচারে যাননি। রাহুল শেষ বেলায় মাত্র দুদিন গেছেন, প্রিয়াঙ্কাও গরহাজির। সব দায়িত্ব একা নিজের ঘাড়ে নিয়ে আশি বছরের বয়সী অসুস্থ শরদ পাওয়ার ম্যাজিক ঘটালেন। কংগ্রেসের তুলনায় বেশি আসন জেতাই শুধু নয়, বিজেপির গর্বে মারাত্মক ঘা দিয়ে তিনি বোঝালেন, অর্থ বল, লোক বল, পেশি বল এবং মিডিয়াকে হাত করে সব সময় সফল হওয়া যায় না। ভারতীয় গণতন্ত্রে মানুষই শেষ কথা।
হরিয়ানা বিধানসভা ভোটের মাত্র ১৫ দিন আগে রাহুল গান্ধীর পছন্দের নেতা অশোক তানওয়ারকে প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে কুমারী শৈলজাকে সামনে আনেন সোনিয়া। ভোটের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুরোনো সৈনিক সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুডাকে। জাট হুডাকে দায়িত্ব দেওয়ার সুফলও পাওয়া যায় হাতেনাতে। রাজ্যের জাট জনতা সমর্থন উজাড় করে দিয়েছে কংগ্রেসকে। গণনা শেষ হওয়ার আগেই প্রদেশ সভাপতি পদে ইস্তফা দিয়েছেন বিজেপির সুভাষ বারালা। মুখ লুকিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার। বোঝা গেল, লোকসভা ভোটে জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য পেলেও রাজ্যস্তরে তাকে গুরুত্ব দিতে মানুষ রাজি নয়। জেজেপি নেতা দুষ্মন্ত চৌটালা অবশ্যই এই রাজ্যে কিং মেকার হতে চলেছেন। কিন্তু কাকে তিনি বাছবেন, বিজেপি না কংগ্রেস, সেই কৌতূহল জারি থাকল।
এই ফল কংগ্রেসের মরা গাঙে অবশ্যই কিছুটা জোয়ার আনবে। সোনিয়ার নেতৃত্বে কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় গতি আনবে। একই সঙ্গে হতোদ্যম করবে বিজেপিকে। অর্থ বল, পেশি বল, লোক বল এবং নমনীয় মিডিয়া যে সব সময় সব নির্ধারণ করে না, ভারতীয় গণতন্ত্র আরও একবার সেই প্রমাণ রাখল। এই ফলের পর আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে আগামী বছরের গোড়ায় দিল্লি ও ঝাড়খন্ড বিধানসভার ভোট।