মহাসড়কে নেই যানজট। সব শঙ্কা উড়িয়ে এবারের ঈদযাত্রা ছিল আনন্দের। তবে শেষ সময়ে বাসে ভাড়া আদায় করা হয়েছে খেয়ালখুশিমতো। কলকারখানা ছুটির পর সন্ধ্যায় ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা অংশে গাড়ির চাপ থাকলেও অতীতের ঈদযাত্রার মতো স্থবিরতা ছিল না। তবে পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেন গতকাল সোমবারও বিলম্বে ঢাকা ছেড়েছে। যাত্রীরা জানিয়েছেন, পথে এক থেকে দুই ঘণ্টা বিলম্ব হলেও ঘরে ফেরার আনন্দের কাছে এ দুর্ভোগ তুচ্ছ। এদিকে বিকাল ৩টার পর থেকেই সদরঘাটে জনস্রোত নামে, লঞ্চঘাটে ঢোকাই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
গতকাল ছিল ঈদের আগের শেষ কর্মদিবস। আগেই ধারণা করা হয়েছিল, ছুটির পর ভিড় বাড়বে। তবে সকাল থেকেই উপচেপড়া ভিড় ছিল ট্রেন ও লঞ্চে। ট্রেন ছাড়তে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি হয়। পদ্মা নদী পারাপারে আরিচা ও মাওয়া ঘাটে গাড়ির চাপ থাকলেও আগের বছরগুলোর মতো অচলাবস্থা ছিল না।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এবারের ঈদযাত্রা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নির্বিঘ্ন। মহাসড়কের কোথাও দীর্ঘ যানজট হয়নি। যেসব সমস্যা রয়েছে, তা শৃঙ্খলায়। বাসমালিকরা লোভী। তাদের লোভে ভাড়া বেশি। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে বাস সময়মতো ছাড়ছে। নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। আবার নির্বিঘ্নে ফিরেও আসছে। মহাসড়কে যানজট না থাকায় তা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবারের মতো এবারের ঈদেও শেষ সময়ে যথেচ্ছ ভাড়া আদায় করছেন বাসমালিকরা। গতকাল ঢাকা থেকে নোয়াখালীগামী রয়েল পরিবহনে ৩৫০ টাকার ভাড়া ৬০০ টাকা নেওয়া হয়। পুলিশের উপসহকারী পরিদর্শক নিজাম উদ্দিন জানিয়েছেন, তার কাছ থেকে দুটি টিকিটের দাম এক হাজার ২০০ টাকা নেওয়া হয়। প্রতিকার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকিটের ছবি আপলোড করেছেন তিনি।
গাবতলীতেও ছিল অভিন্ন চিত্র। চুয়াডাঙ্গাগামী ডিলাক্স পরিবহন বাসের সিটের মাঝে মোড়া বসিয়ে তাতে যাত্রী নেওয়া হয়। ভাড়া নেওয়া হয় ৫৫০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। গাবতলীর ছোট ছোট আরও কয়েকটি পরিবহন শেষ সময়ে ইচ্ছামাফিক ভাড়া আদায় করে। বড় পরিবহনগুলো আগাম টিকিট বিক্রি করেছে। যারা টিকিট পাননি, তারা শেষ সময়ে নামহীন পরিবহনে যেতে বাধ্য হন। দিনাজপুরগামী যাত্রী ইকরাম হোসেন জানান, তার কাছে এক হাজার ২০০ টাকা ভাড়া চাওয়া হয়েছে। চেষ্টা করছেন কমে যেতে।
গতকাল সকাল থেকে যাত্রীর চাপ ছিল কল্যাণপুর, শ্যামলীর বাস কাউন্টারগুলোতে। সন্ধ্যার পর যাত্রীর ঢল নামে। এ ঢলে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা অংশে গাড়ির চাপ বাড়ে।
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বিকেল ৫টার দিকে সাভার-আশুলিয়া এলাকার পোশাক কারখানাগুলো ছুটি হয়। ছুটির পর হাজার হাজার শ্রমিক বাড়ির উদ্দেশে পথে নামেন। তাদের চাপে ও ঢাকা থেকে আসা গাড়ির কারণে মহাসড়কে যানজট না হলেও গাড়ির গতি কমে। শ্রমিকরা পিকআপ, ট্রাকে গন্তব্যে যাত্রা করেন। এতে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়ে। পুলিশের তৎপরতায় যানজট ছাড়লেও রাত পর্যন্ত ধীরে ধীরে গাড়ি চলছিল।
ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগের একমাত্র এ পথের সাভার থেকে চন্দ্রা হয়ে টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ধীরে ধীরে চলেছে গাড়ি। মহাসড়কের এ অংশ চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। গত ২৫ মে কোনাবাড়ি ও চন্দ্রায় ফ্লাইওভার যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ায় আগের বছরগুলোর মতো যানজট নেই।
অভিন্ন অবস্থা ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা অংশে।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সড়কের অবস্থা আগে থেকেই খারাপ। গার্মেন্ট ছুটির পর চাপ বাড়ে সড়কে। বিকেলের পর যানজট সৃষ্টি হয় টঙ্গী থেকে চৌরাস্তা অংশে। গাড়ি চলে থেমে থেমে।
গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় ধরনের যানজটের খবর পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতু চালুর পর থেকেই এ মহাসড়কে যানজট নেই। গতকাল বিকেল থেকে মেঘনা ও গোমতী সেতুর টোলপ্লাজায় গাড়ির চাপ বাড়লেও আগের মতো অচলাবস্থা ছিল না।
গতকাল তীব্র ভিড় ছিল ট্রেনেও। ট্রেনের ছাদে, ইঞ্জিনের সামনে, পাদানিতে ঝুলে যাত্রীরা গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হন ঢাকা থেকে। ঢাকার বাইরে থেকে যেসব ট্রেন কমলাপুরে আসে, সেগুলোও ছিল যাত্রীতে পূর্ণ। যাত্রীরা জানান, ট্রেনে ওঠার দুর্ভোগ এড়াতে বিমানবন্দর স্টেশন থেকেই যাত্রীরা উঠে বসছেন ট্রেনে।
সবচেয়ে ভুগিয়েছে উত্তরবঙ্গের ট্রেনগুলো। সকাল ৮টার চিলহাটিগামী ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’ দুপুর ১টায় কমলাপুর ছাড়ে। ট্রেনটির যাত্রী সাংবাদিক হাসনাইন ইমতিয়াজ জানিয়েছেন, এসএমএসের মাধ্যমে আগেই জানতে পারেন ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে। দুই শিশুসন্তান নিয়ে সকাল সাড়ে ১১টায় স্টেশনে আসেন। দেড় ঘণ্টা পরিবার নিয়ে স্টেশনে বসে থাকতে হয়।
সিল্ক্কসিটি, রংপুর এক্সপ্রেস, একতা, দ্রুতযান, লালমনি ঢাকা থেকে এক থেকে দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার আনিমুল হক জানিয়েছেন, ঈদের সময় ট্রেনের সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে না। তাই সিডিউল রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো ট্রেন একদিন বিলম্ব করলে তা নিয়মিত করা যায়নি। ঈদের পর সাপ্তাহিক বন্ধ চালু হলে সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
সদরঘাটে জনস্রোত : নৌ টার্মিনালে বিকেল ৩টা থেকে জনস্রোত নামে। দলে দলে ঘরমুখো মানুষ আসতে থাকে সদরঘাটের দিকে। ভেতরে ঢুকতে না পেরে শত শত ঘরমুখো যাত্রী টার্মিনালের গেটের বাইরে অবস্থান করেন। ইফতারের সময় কয়েকশ’ যাত্রী টার্মিনালের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। যাত্রীদের কথা, ঈদের সময় ভিড় হয়, তবে এমন ভিড় তারা কখনও দেখেননি। সদরঘাটে আসার পর তারা লঞ্চে গিয়ে বসতে পারেন; কিন্তু এবার ঘাটে আসার পর বাইরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সব গেট বন্ধ থাকার কারণে অনেক মানুষকে দেয়াল টপকে লঞ্চের ঘাটে যেতে দেখা গেছে।