সংসদ নির্বাচনের আগে সিইসি কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের যে রেষারেষি প্রকাশ্য হয়েছিল, তা দেখা গেল আবারও।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোট নিয়ে বৃহস্পতিবার নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার অনুষ্ঠানে এক সঙ্গে ছিলেন তারা।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই।”
বিএনপির বর্জনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা সিটির এই নির্বাচনকে ‘নাতিশীতোষ্ণ’ আখ্যায়িত করে কবি ও গল্পকার মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কর্মকর্তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে রবিঠাকুরের কবিতার আশ্রয় নেন।
এরপর বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে সিইসি নূরুল হুদা বিগত সংসদ নির্বাচনকে ‘সার্থক ও গ্রহণযোগ্য’ আখ্যায়িত করে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ‘কাব্যিক ও পণ্ডিতি’ কথায় কান না দেওয়ার পরামর্শ দেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্বেই ইভিএম নিয়ে তীব্র আপত্তি নিয়ে সহকর্মী নির্বাচন কমিশনারদের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার। এরপর ভোটের সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করলে পাল্টা বক্তব্য আসে সিইসিরও।
ভোটের ঠিক পরপরই এক অনুষ্ঠানে আবার সাবেক আমলা মাহবুব তালুকদারের মুখে সাবেক আরেক আমলা নূরুল হুদার প্রশংসা ঝরলেও বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানে বোঝা গেল, তাদের দ্বৈরথ শেষ হয়নি।
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং দুই সিটির নতুন ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলর নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে।
ওই ভোটে দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া কর্মকর্তাদের দিক-নির্দেশনা দিতে বৃহস্পতিবার সভায় বসেন সিইসিসহ চার নির্বাচন কমিশনার; এতে সভাপতিত্ব করেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
‘জনতার চোখ বলে কথা আছে’
মাহবুব তালুকদার বলেন, “ঢাকা সিটিতে আমাদের উচিৎ হবে একটি শুদ্ধ ও আইনানুগ নির্বাচন করা, যাতে নির্বাচনকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ না পান।”
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার বিষয়ে আমি সবসময় গুরুত্বারোপ করেছি। এই গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই।
“জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে। আমাদের ও আপনাদের সকলের কর্মকাণ্ড জনতার চোখে পরীক্ষিত হবে। সুতরাং যথার্থ একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার জন্য আমাদের সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে।”
একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে মাহবুব তালুকদার বলেন, “বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তথ্য- উপাত্ত নিয়ে আমি কিছুটা পড়াশুনা করার চেষ্টা করেছি। এর অভিজ্ঞতা কিঞ্চিত আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি, যা আপনাদের সহায়ক হতে পারে। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মূলত দুই প্রধান শক্তির উপর নির্ভরশীল। একদিকে নির্বাচন কর্মকর্তা বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
“আমি এখন পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র দেখেছি, তাতে রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষক পর্যন্ত সকলের প্রতিবেদনে দুটি শব্দ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি শব্দ হচ্ছে সন্তোষজনক এবং অন্য শব্দটি হচ্ছে স্বাভাবিক। তার মানে কি আমাদের নির্বাচন খুবই সন্তোষজনক হয়েছে? এই ক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন কী, তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে।”
বরাবরের মতো লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মাহবুব তালুকদার।
ঢাকার আসন্ন ভোট নিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তাকে আমি নাতিশীতষ্ণ নির্বাচন বলব। কারণ এই নির্বাচনে মেয়র পদে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা ছিল, যে উত্তাপ ও উষ্ণতা থাকার কথা ছিল, তা মনে হয় হবে না। কেবল কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিছুটা উষ্ণতা আশা করা যায়।”
সমান সুযোগ না থাকার দাবি তুলে ঢাকা উত্তরে গত নির্বাচনে প্রধান বিরোধী প্রার্থীর ভোট বর্জনের কথাও তুলে ধরেন মাহবুব তালুকদার।
তিনি বলেন, “যদিও সত্যিকার অর্থে এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী নেই। তবুও নির্বাচনে অনিয়মের কথা বলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনা যে ঘটবে না, তা বলা যায় না।”
জাতীয় নির্বাচনের দুই মাসের মধ্যে ঢাকার এই নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “দেশের মানুষ, এমনকি উন্নয়ন সহযোগীরা তাকিয়ে আছেন, আমরা কী ধরনের নির্বাচন উপহার দেই তা দেখার জন্য।”
কোনো চাপ, ভীতি বা প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার না করার আহ্বান জানিয়ে কবিগুরুর কবিতা উদ্ধৃত করে নির্বাচন কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।”
‘খোঁচা-ধাক্কায় বিচলিত হবেন না’
মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের পর মঞ্চে দাঁড়ান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সিইসি নূরুল হুদা।
সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “কয়েকদিন আগে আপনার সুন্দর নির্বাচন করেছেন। একটা সার্থক নির্বাচন করেছেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছেন। একটি সরকার প্রতিষ্ঠার কাজ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। এজন্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাই।
“সংসদ নির্বাচনের সময় ঢাকা সিটিতে যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন আপনারা, প্রশংসিত হয়েছেন, নন্দিত হয়েছেন বিভিন্নভাবে। দেশি-বিদেশি অবজারভার যারা ছিলেন, সাংবাদিক যারা ছিলেন, তারা আপনাদের বিষয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি।”
“আপনাদের মধ্যে স্বচ্ছতা ছিল, নিরপেক্ষতা ছিল; ধৈর্য ছিল এবং সাহসিকতা ছিল, যে যাই বলুক না কেন,” বলেন সিইসি।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নতুন নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তাদের অভিযোগ, ইসি এই নির্বাচনে কারচুপির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে।
ওই নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে সিইসি বলেন, “অনেক পরিশ্রম করে, প্রতিকূলতা-সমালোচনার মধ্যে এবং নানা রকমের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে নির্বাচনের উত্তরণ ঘটিয়েছেন। ফলে দেশ পরিচালনার জন্য একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রয়েছে।”
কারও নাম উল্লেখ না করে নূরুল হুদা বলেন, “আরেকটা কথা হল, অনেকে অনেক তীর্যক কথা বলবেন, পাণ্ডিত্যমূলক কথা বলবেন, অনেকে অনেক উপদেশমূলক কথা বলবেন, গম্ভীর গম্ভীর কথা বলবেন। সেখান থেকে যতটুকু আহরণ করা দরকার করবেন, প্রয়োগ করা দরকার করবেন এবং সবচেয়ে বড় কথা আপনারা নিজের মেধা, যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, সাহস, নিরপেক্ষতা এবং নিজের যে আস্থা সেটা সব থেকে বড় কথা।
“কবিতা, গল্প দিয়ে আপনাদের পেট ভরানো যাবে না। আপনাদের নিজস্ব সত্ত্বা আছে, নিজস্ব যে দায়িত্ব আছে, নিজস্ব যে জ্ঞান আছে সেটাই প্রয়োগ করবেন।”
“এখানে একজন টোকা দিলো, খোঁচা দিল নতুবা ধাক্কা দিল, তাতে আপনারা বিচলিত হবেন না। আপনাদের দায়িত্ব যেভাবে দায়িত্ব পালন করা দরকার সেভাবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন,” বলেন সিইসি।