রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরতে পারার মতো পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমারকে রাজি করানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং।
বৃহস্পতিবার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন।
বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য ওই এলাকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হচ্ছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর জন্য এটা খুবই দরকার।
“যতদিন দিন যাবে ততই এই চ্যালেঞ্জটা বড় হবে। সুতরাং এটার দ্রুত একটা সমাধান করা দরকার। আর সমাধান হল- এরা যেন তাদের নিজস্ব মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে।
“চীনের প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে একমত যে, ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এ সমস্যার সমাধান হবে।”
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের উদ্যোগগুলো বৈঠকে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “এর আগে আমরা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছি। আমরা সব ধরনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা যেতে চায় না। কারণ তারা মনে করে যে, ওইখানে তাদের ভয় আছে।”
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “উনি (শেখ হাসিনা) মিয়ানমারে একটা অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে চাইনিজদের ভূমিকার কথা বলেছেন। যাতে তারা নিরাপত্তা, মর্যাদা ও নাগরিকত্ব এই তিনটা জিনিস পায় এবং নিজ ভূমি ও সম্পত্তিতে প্রবেশ করতে পারে।”
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান লি খ্য ছিয়াং।
শহীদুল হক বলেন, “চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, উনারা বুঝতে পারেন যে এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এটা যে একটা বড় সমস্যা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তারা মনে করেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিলেই এটার সমাধান করতে হবে। এ ব্যাপারে চাইনিজরা আগেও হেল্প করেছেন।
“উনারা বলেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুজনেই চীনের বন্ধু। সুতরাং দুই দেশ মিলেই যেন এ সমস্যার সমাধান করে, চেষ্টা করে, ডায়ালগ করে এবং সমাধান খুঁজে পায়। তারা বলেছেন, তারা চেষ্টা করবেন যে, দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমেই যেন এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পায় এবং চায়না মিয়ানমারকে ওই ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করবে।”
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টা থেকে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে প্রায় আধা ঘণ্টা এ বৈঠক চলে। বৈঠকের পর দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুদেশের মধ্যে নয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই হয়।
বেলা পৌনে ১১ টার দিকে শেখ হাসিনা গ্রেট হল অব দ্য পিপলে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান লি খ্য ছিয়াং। গ্রেট হলের সামনে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এরপর সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়।
তোপধ্বনির পর সুসজ্জিত একটি বাদক দল দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে শোনায়। অভ্যর্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় বৈঠক।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে চীনের চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ চায়নার পার্টনার। চায়না বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে মূল্য দেয়। আমরা এই সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।এখন আমাদের (চীন) সাথে বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক আছে।
“এটা আরও গভীর হবে, শক্তিশালী হবে বলে তারা আশা করে। তারা মনে করে যে, বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে এটা অব্যাহত থাকবে এবং এ ব্যাপারে তারা বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।
“আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, আমরা শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে গুরুত্ব দিই। মানুষের কল্যাণে যাতে শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন বিঘ্নিত না হয় তার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করে যাব। আমাদের বিনিময় করার মতো অনেক কিছু আছে।”
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটসহ পাঁচটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। অন্য বিষয়গুলো হচ্ছে- অর্থ ও বাণিজ্য, প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা, বিসিআইএম বা কানেকটিভিটি ও ভিসা।
গতবছর বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৬ শতাংশ বেড়েছে, যার বেশিরভাগই চীনের পক্ষে।
“বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেছেন, যেহেতু বাণিজ্য চায়নার পক্ষে, সেক্ষেত্রে এই অসমতা চিহ্নিত করতে হবে। চায়নারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে কারখানা ও শিল্প গড়ে তুলতে পারে।
“এ বিষয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক চাই। বাণিজ্য ভারসাম্য তৈরির জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন উনি।”
চীনে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। বাণিজ্য সমতা ফেরানোর জন্য এখন বাংলাদেশের ৩ শতাংশ পণ্যের ওপর যে করারোপ করা আছে সেটা দূর করতেও দেশটির প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “চীনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমরা একটা ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক চাই। একথা আগে তারা বলেনি।”
চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় যেসব সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল তার বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা ও শর্তাবলী শিথিল করার কথা বলেছেন শেখ হাসিনা।
“চীনের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে, উনি এ জিনিসটা দেখবেন।”
শহীদুল হক বলেন, “ডেল্টা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চায়নার সহায়তার কথা বলেছেন। একইসঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিষয়েও চীনের অব্যাহত সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
“জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন কেন্দ্র করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে চায়নার সহায়তা চেয়েছেন।”
‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিস্টোরেশন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত হাই স্পিড ট্রেন চালুর বিষয়েও শেখ হাসিনা চীনের সহযোগিতা চেয়েছেন বলে জানান শহীদুল হক।
চীনারা বাংলাদেশে অন অ্যারাইভাল ভিসা পেলেও বাংলাদেশিরা চীনে তা পায় না। তাই ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরাদের অন অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়ার অনুরোধ করেছেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার কানেকটিভিটি করিডোর নিয়েও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন বলে জানান শহীদুল হক।
“দুই প্রধানমন্ত্রী বিসিআইমের গুরুত্ব, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাজার সম্প্রসারণের যে সম্ভাবনা আছে সেটা তুলে ধরেছেন এবং বিসিআইএম দ্রুত বাস্তবায়নে দুই দেশই সম্মত হয়েছে।”
গ্রেট হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার মেয়ে বাংলাদেশের অটিজম বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।
এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।