জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারকে জরুরি ভিত্তিতে চার দফা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়ার দুই দিনের মাথায় দেশটির সেনাবাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলায় গর্ভবতী একজনসহ দুই রোহিঙ্গা নারী নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে।
শনিবার রোহিঙ্গাদের একটি গ্রামে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণে ওই দুই নারী নিহত ও আরও সাত জন আহত হয়েছে বলে দেশটির একজন পার্লামেন্ট সদস্য ও একজন গ্রামবাসীর বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় শহর বুথিডাং থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য মং কিয়াও জান জানান, গভীর রাতে নিকটবর্তী ব্যাটেলিয়ন থেকে ছোড়া গোলা কিন তায়ুং গ্রামে আঘাত হানে।
টেলিফোনে রয়টার্সকে তিনি বলেন, “কোনো যুদ্ধ ছাড়াই একটি গ্রামে কামানের গোলা নিক্ষেপ করেছে তারা, সেখানে কোনো লড়াই ছিল না।”
চলতি বছরে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সেখানে বেসামরিকদের হত্যা করা হল বলে জানিয়েছেন তিনি।
কিন তায়ুং থেকে মাইলখানেক দূরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা গ্রামবাসী সো তুন ওও ফোনে রয়টার্সকে গোলার বিস্ফোরণে দুটি বাড়ি ধ্বংস হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “মিলিটারিরা সব সময় ভারী অস্ত্র থেকে গোলাবর্ষণ করে। যে এলাকাকেই সন্দেহজনক মনে হয় সেখানেই ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ করে তারা। আমরা ভয়ে থাকলেও অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।”
এ হামলার দায় অস্বীকার করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। হামলার দায় বিদ্রোহীদের দিয়েছে তারা। ভোররাতে বিদ্রোহীরা একটি সেতুতে আক্রমণ চালিয়েছিল বলে জানিয়েছে তারা।
রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ভিকে-তে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, দুই রোহিঙ্গা নারী নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করলেও এর জন্য আরাকান আর্মিকে দায়ী করেছে। দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আরাকান আর্মির গোলা ওই গ্রামে আঘাত হেনেছে বলে দাবি করেছে তারা।
হতাহতের এ ঘটনা নিয়ে মন্তব্যের জন্য ফোন করা হলেও মিয়ানমারের দুই সামরিক মুখপাত্র জবাব দেননি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
রাখাইনে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী এক বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় নৃগোষ্ঠীগত বিদ্রোহী বাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
২০১৭ সালে এই রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর দমনাভিযান চালিয়েছিল। তখন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা জান বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। গণহত্যার অভিপ্রায় নিয়ে ওই দমনাভিযানটি চালানো হয়েছিল বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে।
এখনও রাখাইনে ছয়-সাত লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের অনেকেই জাতিবিদ্বেষের মতো পরিস্থিতিতে আটকা পড়ে আছেন। তারা মুক্তভাবে চলাচল করতে পারছেন না, এমনকী হাসপাতালে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যেতে পারছেন না।
সম্প্রতি রাখাইনের স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে গঠিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে দেশটির সামরিক বাহিনীর লড়াই শুরু হয়েছে। এ লড়াইয়ে বহু লোক নিহত ও হাজার হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। রোহিঙ্গারা এই লড়াইয়ের মাঝে আটকা পড়ে গেছে।
রাখাইন রাজ্যে মুক্তভাবে চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ থাকায় লড়াই শুরু হলে বৌদ্ধ প্রতিবেশীদের চেয়ে রোহিঙ্গাদের পালানো সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে নেদারল্যান্ডের দ্য হেগ-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) বৃহস্পতিবার মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ওপর যেন আর কোনো নৃশংসতা না হয় তা নিশ্চিত করে তাদের সুরক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
নভেম্বরে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আইসিজেতে একটি অভিযোগ দাখিল করে। ওই অভিযোগ ও গাম্বিয়ার একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারকে কথিত অপরাধের আলামত সংরক্ষণসহ চার দফা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস।