২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) থান টের (Than Htay) নেতৃত্বাধীন ও TATMADAW (মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী) সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) বিরুদ্ধে নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। TATMADAW তথা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করে যার পরিপ্রেক্ষিতে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু মিয়ানমার নির্বাচন কমিশন তা বিবেচনায় না নিয়ে সংসদ অধিবেশন প্রস্তুতির কাজ করছিল। মূলত দুটি কারণ TATMADAW কে সেনা অভ্যুত্থানের দিকে পরিচালিত করেছিল-
ক। নির্বাচন কমিশন TATMADAW এর অভিযোগগুলো বিবেচনায় না নেওয়ায় তাদের অহংবোধে আঘাত লাগে, ফলে তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
খ। TATMADAW বুঝতে পেরেছিল, সুচি যদি সরকার গঠন করে এবং পরবর্তী ৫ বছর অসামরিক সরকার যদি দেশ পরিচালনা করে তবে রাজনীতিতে এবং দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে) সামরিক বাহিনীর প্রভাব মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। সুতরাং কিছু করতে হলে এখনই, না হয় কখনই তা সম্ভব হবে না। ফলশ্রুতিতে গত ১ ফেব্রুয়ারি সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লার নেতৃত্বে TATMADAW সেনা অভ্যুত্থান করে।
২। সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লা: সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লা একজন বামার (মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়)। তিনি সামরিক বাহিনীতে একজন মধ্যম মানের অফিসার হলেও শান্ত, দৃঢ় এবং লক্ষ্য অর্জনে অটল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। এছাড়া তিনি কিছুটা অহংকারীও বটে। ২০০৮ সালের সংবিধানে (সামরিক বাহিনী প্রণীত) প্রদত্ত ক্ষমতা অপব্যবহার করে তিনি নিজের মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়ে নিয়েছিলেন যা চলতি বছর শেষ হবে। ২০১১ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হওয়ার পরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের একটি অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে’। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর তীব্র নির্যাতন-নিপীড়ন দেখেছি। ২০১৭ সালে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগত নির্মূলকরণের’ পরে যখন পশ্চিমা ও বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সচেষ্ট ছিল, তখন তার মন্তব্য ছিল ‘আমরা তাদের বিতাড়িত করেছি ফেরত আনার জন্য নয়’। মিয়ানমারের এই শক্তিশালী মানুষটি TATMADAW নামক এমন একটি সংস্থাকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা শুধুমাত্র একটি সশস্ত্র বাহিনী নয়, তার চেয়েও সম্ভবত অধিক শক্তিশালী একটি সংগঠন।
৩। TATMADAW: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে TATMADAW বিগত সাত দশক ধরে মিয়ানমার শাসন করছে। দীর্ঘ সময়ের সাথে সাথে সামরিক শাসনের অধীনে সামরিক বাহিনী দানবে পরিণত হয়ে থাকে এবং TATMADAWও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি সম্বলিত জ্ঞান ও মেধাভিত্তিক এমন একটি সংস্থা যা মিয়ানমারের অন্যান্য সংস্থার উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এমন দানবীয় মনোভাবসম্পন্ন ও সাথে মেধার সংমিশ্রণযুক্ত সংস্থা যেকোনো দেশের জন্য বিপদজনক। তারা বিশাল ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করাসহ প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং ইমিগ্রেশন (সীমান্ত) মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও তাদের প্রভাব রয়েছে। সংবিধানে TATMADAW সমর্থিত রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্বাচনে অর্জিত আসনের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর জন্য পার্লামেন্টে ২৫% আসন বরাদ্দের বিধান রয়েছে। জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা কাউন্সিল, দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী সংস্থা, যা প্রয়োজনে সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই কাউন্সলটি সামরিক সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃত্বাধীন। মিয়ানমার জেনারেলরা অত্যন্ত চতুর। তারা যেভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামাল দিয়েছিলেন এবং এমনভাবে উভয় আঞ্চলিক শক্তি এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের (UNSC) দুই স্থায়ী সদস্যকে তাদের পক্ষে নিয়েছিলেন যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের ভূ–রাজনীতি এবং ভূ–কৌশল প্রশংসনীয়। যখন কেউ TATMADAW জেনারেলের সাথে আলোচনায় বসেন, তখন তিনি কেবল কোনো সামরিক ব্যক্তির সাথে বসেন না, একজন বুদ্ধিজীবী, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং একটি শক্তিশালী সংগঠনের নেতার সাথে বসেন যাদের কয়েক দশক ধরে দেশ পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান রয়েছে। তারা বলে কম, শোনে বেশি এবং তাদের প্রকাশ খুব কম। রোহিঙ্গা ইস্যুর ক্ষেত্রে আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা পেশাদারদের সমন্বয়ে গঠিত একটি তুখোড় কূটকৌশলীর বিপক্ষে কাজ করছি।
৪। অং সান সুচি: ১৯৯০ এর দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের জন্য তিনি বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠেন। সামরিক জান্তা কর্তৃক ১৯৮৭–২০১০ সালের মধ্যে তিনি ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিলেন এবং ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে ২৫ বছর পর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে এনএলডি বিজয়ী হয়েছিল। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক ক্র্যাকডাউনের নিন্দা না করায় তিনি সারা বিশ্বে সমালোচিত হন। তার পশ্চিমা সংযোগ, গণতন্ত্র এবং শান্তির পক্ষে লড়াই তাকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি কেবল একজন বর্ণবাদী, ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ। এটি বলার কারণ-
ক। ২০১৪ সালে আমি যুক্তরাজ্যের স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমিতে তার বক্তব্য শুনতে গিয়েছিলাম। বক্তব্যের পরে তার দেশে বিশেষতঃ রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে তার অবস্থান জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘু ‘উভয়ই ভয়ে’ রয়েছে এবং এটি আসলেই ভয়ের বিষয়। তাই এ সম্পর্কে তার কোনো মন্তব্য নেই। তিনি এমন একজন ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ যিনি ২০১৫ সালে আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভের জন্য রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় বা TATMADAW এর বিরুদ্ধে যাননি বা তাদের অখুশি করতে চাননি।
খ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি হেগ-এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) TATMADAW কে গণহত্যা এবং ‘জাতিগত নির্মূলকরণ’ এর অভিযোগ থেকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। আইসিজে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে তিনি দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তখন মিয়ানমারের প্রতিটি অঞ্চলে সুচির পিছনে TATMADAW জেনারেলদের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপন করা হয় এবং তাতে লেখা ছিল ‘আমরা আপনাদের সাথে আছি’। তিনি ২০২০ সালের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ ও ক্ষমতার লোভে গণতন্ত্র ও শান্তির নায়ক হিসেবে অর্জিত তার খ্যাতিকেও ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন। আইসিজে আদালত কক্ষে আমরা তার কাছ থেকে মাত্র ২০ ফুট দূরে বসেছিলাম। গাম্বিয়া কর্তৃক উপস্থাপিত গণহত্যার প্রমাণ উপস্থাপনকালে তিনি শান্ত ও উদাসীন ছিলেন। গাম্বিয়ান আইনজীবী যখন পর্দায় Inn Din গ্রামে গণহত্যার ছবি দেখালেন যেখানে রোহিঙ্গা পুরুষদের একসাথে হাঁটু গেড়ে বসানোর ছবি এবং পরবর্তীতে তাদের শিরচ্ছেদ করা ছবিটি দেখানো হলো, যা আদালত কক্ষের প্রায় সবাইকে স্পর্শ করেছিল। কিছু রোহিঙ্গা বিধবাও আদালত কক্ষে ছিলেন, যাদের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা আদালতের পরিবেশকে ভারি করে তুলেছিল। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম গণতন্ত্র ও শান্তির তথাকথিত জননী সুচির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলনা। তার মুখে ছিল উদাসীনতার হাসি।
গ। ২০১৩ সালে বিবিসির উপস্থাপিকা মিশাল হোসেন সুচির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলন যেখানে তিনি সুচিকে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়টি উল্লেখ করে তা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ না করায় একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থতার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। সুচি বিড়বিড় করে তার সেই চিরচেনা বক্তব্য ‘দু পক্ষই ভয়ে আছে’ বলেছিলেন এবং মিশাল হোসেনের সাথে তার সাক্ষাৎকারে তিনি কোনঠাসা হয়ে উঠেন। সাক্ষাৎকারের পরে সুচি তার একজন সহযোগীর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘কেউ আমাকে বলেনি যে আমাকে একজন মুসলমানের দ্বারা সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে’। এরকম আচরণ গণতন্ত্রের জননী, মানবতার আইকন এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর হতে পারে না। এই আচরণ একজন খাঁটি বর্ণবাদীর। তিনি একজন ক্ষমতালোভী বর্ণবাদী রাজনীতিবিদ যিনি বামার আধিপত্য দ্বারা আক্রান্ত। তিনি রোহিঙ্গাদের ঘৃণা করেন। তিনি একজন কৌশলী রাজনীতিবিদ হতে পারেন, তবে TATMADAW তার চেয়ে অধিক কৌশলী।
৫। চীন: ২০১৯ সালে চীন সফরকালে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লা চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিংয়ের সাথে সাক্ষাতকালে রাষ্ট্রপতি শি বলেন, মিয়ানমার চীনের কৌশলগত অংশীদার (কৌশলগত অংশীদার, উন্নয়ন অংশীদারও বটে, তবে উন্নয়ন অংশীদার অবশ্যই কৌশলগত অংশীদার নয়, বাংলাদেশ চীনের একটি উন্নয়ন অংশীদার)। উত্তরে সিনিয়র জেনারেল বলেছিলেন, TATMADAW সর্বদা চীনের পাশে থাকবে। এই শব্দভাণ্ডারগুলোর গভীর অর্থ রয়েছে। চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা একটি কৌশলগত ইস্যু এবং চীনা অর্থনৈতিক বিকাশের মূল কেন্দ্র। চীনের গ্যাস ও তেল পাইপলাইন মিয়ানমারের কিউকফিউ (সিট্যুয়ে) বন্দর থেকে রাখাইন রাজ্যের (যেখানে রোহিঙ্গাদের আবাস ছিল) বেশিরভাগ অংশ হয়ে কুনমিং (চীন) পর্যন্ত বিস্তৃত। চীনের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমারকে দরকার। চীন যতটা সম্ভব মালাক্কা প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগর এড়াতে চাইবে। ফলে সামরিক জান্তাকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে চীনের বিবেচনা কৌশলগত, উপরন্তু কোনো নৈতিক দ্বিধাও নেই।
৬। রাশিয়া: মিয়ানমারে চীনের পর বৃহত্তম অস্ত্র বিক্রয়কারী দেশ রাশিয়া। তাদের পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা অত্যন্ত দৃঢ় ও গভীর। সেনা অভ্যুত্থানের পর ২০২১ সালের ২৭ মার্চে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজে রাশিয়ার একটি কন্টিনজেন্ট অংশ নিয়েছিল। এমনকি রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং রাশিয়ার এই অংশগ্রহণকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় রাশিয়ারও জান্তা সমর্থন করার ক্ষেত্রে নৈতিক দ্বিধা নেই।
৭। ভারত: ভারতের কালাদান বহুমূখী ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পটি বঙ্গোপসাগর, কালাদান নদী এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দিয়ে তার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সাথে যোগাযোগের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা। ভারত এই প্রকল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ভারত ও তার পশ্চিমা মিত্ররা চায় না মিয়ানমার চীন দ্বারা পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রিত হোক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে, ভূ–রাজনৈতিক কারণে ভারত তার নৈতিক দ্বিধা লুকিয়েছিল কিন্তু মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের ঘটনায় তার নৈতিক দ্বিধা গোপন করতে পারেনি।
৮। সম্ভাব্য ভবিষ্যত কি? যতক্ষণ চীন ও রাশিয়ার সমর্থন রয়েছে ততক্ষণ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী দুটি কারণে ক্ষমতায় থাকবে-
ক। তারা চাপে পড়ে হাল ছেড়ে দিলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশ পরিচালনায় তাদের আধিপত্য চিরদিনের জন্য খর্ব হয়ে যাবে।
খ। TATMADAW মনে করে সামরিক বাহিনী ছাড়া মিয়ানমার খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবে ও অচল হয়ে পড়বে।
৯। ঐক্য সরকার (Unity Government): যা এনএলডি’র লিডারশিপের আওতায় গঠন করা হয়েছে। এই উদ্যোগ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নাগরিক অবাধ্যতাকে (Civil Disobedience) আরও বেশি গতি দেবে কিন্তু জান্তা অপসারণে কোনো অগ্রগতি করতে পারবে না বলে অনুমেয়। ASEAN ইতোমধ্যে সামিটে যোগ দেওয়ার জন্য মিন অং হ্লাইংকে আমন্ত্রণ জানিয়ে জান্তা সরকারকে বৈধতা দিয়েছে। তবে ঐক্য সরকার তার সামরিক শাখাসহ (সব জাতিগত সশস্ত্র গ্রুপকে একত্রিত করে) TATMADAW এর উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারলে জান্তার অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে। এটি মনে রাখতে হবে যে, নিষ্ঠুর শক্তি কেবলমাত্র নিষ্ঠুর শক্তিকেই আমলে নেয়। আন্তর্জাতিক চাপ, নিষেধাজ্ঞা বা আলোচনার মাধ্যমে কোনো ফলপ্রসু সমাধান হবে না বলে অনুমেয়। অতীতে এ সকল চাপ TATMADAW কে অবনত করতে পারেনি।
১০। ASEAN কর্তৃক শান্তি সমঝোতা: এটি মিয়ানমারের নাগরিক অবাধ্যতার বিরুদ্ধে TATMADAW এর বর্বরতা হ্রাস করতে পারে, তবে সামরিক বাহিনী এনএলডির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করবে না। TATMADAW মনে করে যে, এই অপশনটি তাদের শক্তি হ্রাসপূর্বক তাদেরকে অসামরিক/রাজনৈতিক শক্তির অধীনস্থ করবে যাতে তারা সম্মত নয়। তবে দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে পুনরায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি পূরণের বিনিময়ে তারা সুচিসহ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে রাজি হতে পারে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের দু’টি স্থায়ী সদস্য তাদের পক্ষে রয়েছে ততক্ষণ তাদের লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলশ্রুতিতে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে সময়ের সাথে সাথে চীন ও রাশিয়ার স্বার্থও ক্ষুণ্ন হবে, আর সম্পদ সমৃদ্ধ মিয়ানমার দরিদ্র হয়ে পড়বে।
১১। বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি: বর্তমানে TATMADAW এর দৃষ্টি ক্ষমতায় টিকে থাকার উপর নিবদ্ধ রয়েছে বিধায় সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র দলগুলো অত্যন্ত সক্রিয় থাকবে। রাখাইনে আরাকান আর্মিও সক্রিয় থাকবে। রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপকে রাখাইনে আরও শক্তিশালী অবস্থায় দেখা যেতে পারে। আরাকান আর্মি এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নীতি অনুসরণ করতঃ মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্যারেন, কাচিন, শান প্রদেশের সশস্ত্র গ্রুপগুলো একই কাজ করবে। তবে যখন TATMADAW দেখবে যে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে উঠছে তখন ইউনিয়নের ত্রাণকর্তা হিসেবে তাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করার জন্য রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে মনোনিবেশ করতে পারে। কারণ চীন, ভারত এবং থাইল্যান্ড সীমান্তে অন্যান্য সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে TATMADAW অভিযান পরিচালনা করতে দ্বিধাবোধ করবে। কিন্তু রাখাইন সংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্তে সামরিক অভিযান পরিচালনার অতীত অভিজ্ঞতা বলে তারা কোনোরূপ দ্বিধা বোধ করবে না। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের দুর্গম অঞ্চলে বাড়তি প্রভাব (Spillover effect) পড়তে পারে। অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যেতে পারে। যখন নেপিডো, ইয়াঙ্গুন এবং মান্ডালের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে তখন রাখাইনে আরাকান আর্মি এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে TATMADAW কর্তৃক সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হতে পারে।
১২। সম্ভাব্য করণীয়:
ক। প্রতিবেশী দেশকে অস্থিতিশীল করতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারকারী বিদেশি সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ অনুসরণ করে তা বজায় রাখা উচিত।
খ। সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বাড়ানো যেতে পারে (to avoid being surprise)। তবে মিয়ানমারের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতঃ বাংলাদেশ সাবধানতার সাথে অগ্রসর হতে পারে এবং দ্রুতই কোনো পদক্ষেপ বা পক্ষ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।
গ। এই পরিস্থিতিতে নীরবতা বা মৌন সমর্থনের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য TATMADAW নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সাথে Track Two কূটনৈতিক উদ্যোগ এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। এছাড়াও Track Two এর আওতায় রোহিঙ্গাদের এনএলডি নেতৃত্বাধীন ঐক্য সরকারের সাথে সংহতি জানাতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে এনএলডি নেতৃত্বাধীন ঐক্য সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখাতে পারে।
ঘ। মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান/গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ যথাযথ সম্মান অর্জন করেছে। এই মহতী উদ্যোগ যাতে বাংলাদেশের উপর বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়। সকল রোহিঙ্গার অধিকারপূর্ণ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন আজ দূরাশার শামিল। তথাপি, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই হবে বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য যা নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা বা বিষয়ের আদলে সমাধা করা যাবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা TATMADAW এর মতো চতুর ও চৌকষ প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছি।
১৩। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা গণহত্যা কেন? মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী, এটি কি শুধুমাত্র তথাকথিত আরসা কর্তৃক মায়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর উপর আক্রমণের প্রতিশোধ ছিল? আঞ্চলিক শক্তিগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরব কেন? কেন প্রায় সকল জাতি গোষ্ঠীর সাথে মিয়ানমার সরকারের দ্বন্দ্ব?
অন্য কোনো লেখায়/প্রবন্ধে আমি এই বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করার আশা রাখি।