মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করে সরকারের জারি করা সব গেজেট অবৈধ ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।
বয়সসীমা নির্ধারণের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে ১৫টি রিট আবেদনে দেওয়া রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ রোববার এ আদেশ দেয়।
একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮ এর ২(১১) ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক বয়সসীমা নির্ধারণের বিধানকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।
এছাড়া আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বকেয়াসহ বন্ধ থাকা সম্মানী ভাতা পরিশোধ বা চালু করতে বলেছে আদালত। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে তা কার্যকর করতে বলেছে।
আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম আলতাফ হোসেন, ওমর সাদাত, ইউনুছ আলী আকন্দ, মো. জাহাঙ্গীর জমাদ্দার, নারগিস তানজিমা, সেলিনা আক্তার চৌধুরী, শরীফ আহমেদ, শুভ্রজিত ব্যানার্জি ও এ আর এম কারুজ্জামান কাকন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।
পরে ওমর সাদাত সাংবাদিকদের বলেন, “যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছিলেন, কোনো রকম কারণ দর্শানের নোটিস ছাড়াই তাদের ভাতা বন্ধ করে দিয়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বয়স ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১২ বছর ৬ মাস হয়নি তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন না।
“সংবিধান এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণে দেখবেন, তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেখানে বয়সের কোনো ব্যপার ছিল না। বীর প্রতীক ছিলেন শহীদুল ইসলাম লালু, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১০ বছর। বঙ্গবন্ধু তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন এবং বীর প্রতীক খেতাব দিয়েছিলেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে বীর প্রতীক তো ননই, তিনি আজ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও বিবেচিত হবেন না। আদালত এ নিয়ে অত্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করেছেন।”
রায় দিতে গিয়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন জানিয়ে এ আইনজীবী বলেন, “যেটার ওপর ভিত্তি করে আমাদের দেশ হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের যদি আমরা অস্বীকার করি তাহলে দেশ হিসেবে আমরা সামনে আগাতে পারব না। আদালত মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স সংক্রান্ত সকল গেজেট বাতিল করেছেন এবং বকেয়াসহ তাদের সমস্ত পাওনা ফেরত দিতে বলেছেন।”
২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর যে পরিপত্রটি জারি করা হয় পরবর্তীতে সেটিই ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণ’ করে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ন্যূনতম ১৩ বছর হতে হবে।
এরপর ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি আরেকটি গেজেটের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর জারি করা গেজেটে বয়স প্রতিস্থাপন করে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস করা হয়।
এই দুটি গেজেট ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮ এর ২(১১) ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক বয়সসীমা নির্ধারণের ধারার আংশিক চ্যোলেঞ্জ করে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধারা হাই কোর্টে পৃথক ১৫টি রিট অবেদন করেন। ওইসব রিটে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বোবার এ রায় দিল উচ্চ আদালত।
বয়সের ফ্রেমে বেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখেনি। মুক্তিযুদ্ধ মানুষ আবেগ দিয়ে করে, দেশ প্রেম থেকে করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বয়স, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে যোগ দিয়েছেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে বয়স কোনো কারণ না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদাহারণ টেনে আদালত বলেন, ৭-৮ বছর বয়সীরা সে সময় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশে বই, সিনেমা আছে শিশু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। তাই বয়সের ফ্রেমে বেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক দলিল, প্রমাণের ভিত্তিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
বীর প্রতীক শহিদুল ইসলাম লালুর উদাহরণ টেনে আদালত আরও বলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ১০ বছর বয়সী শহিদুল ইসলাম লালুকে বীর প্রতীক খেতাব দিয়েছেন, সেখানে সরকার কীভাবে আবেদনকারীদের ১০ বছর বয়সী কিংবা অমুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করে। লাল মুক্তিবার্তার বাইরেও অনেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা আছে। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তনের কোনো আইনগত এখতিয়ার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধাকে কাউন্সিলকে দেওয়া হয়নি।
রায়ের শেষ পর্যায়ে এসে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পড়ছিলেন। হঠাৎই তিনি থেমে যান।
এরপর কান্না জড়ানো গলায় বলেন, ‘আমি একটু ইমোশনাল হয়ে গেছি। আমার মনে হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চে ভোর বেলায় দেওয়া স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি পড়লে যে কেউই আবেগপ্রবণ হয়ে যাবেন।”
এসময় বার বার চোখ মোছেন বেঞ্চের এই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। এসময় রিটকারী পক্ষের আইনজীবীরা দাঁড়িয়ে যান।