রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) এ শীর্ষ নেতাকে হত্যার পেছনে খোদ মিয়ানমার সরকার জড়িত। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে যাদের রয়েছে সদূরপ্রসারী চক্রান্তের রোডম্যাপ। এর পেছনে আন্তর্জাতিক কানেকশনে আরও প্রভাবশালী মহলের বিশেষ যোগসূত্রতাও থাকতে পারে।
তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার পরিবর্তে এদের পুঁজি করে নানা ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। জুলুম-নির্যাতন করে বাংলাদেশের মধ্যে ঠেলে দেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন অস্ত্র ও মাদক সরবরাহ করা হচ্ছে। এদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে পরিণত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর এমন সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে সক্রিয় রয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থার চৌকস কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চক্রটি তাদের মিশন সফল করতে ইতোমধ্যে সীমান্তের কাছাকাছি ১২টি মোবাইল টাওয়ার বসিয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে লক্ষাধিক মিয়ানমারের মোবাইল ফোন সিম এমপিটি সরবরাহ করেছে। এসব সিমে কম পয়সায় কথা বলা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা দিতে নানা রকম অফার ছাড়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ সিম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানোসহ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ঘোরবিরোধী গোষ্ঠীর পরিসর বাড়াতে তারা এ ধরনের নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম সোমবার বলেন, যদি এভাবে দেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের সিম ব্যবহার হয়ে থাকে তাহলে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তিনি মনে করেন, বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তবে মিয়ানমার সরকার এসব সিম ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠী সৃষ্টি করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দিচ্ছে কিনা সেটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এমন কিছু হলে অবশ্যই দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এ চক্রান্তের প্রথম অ্যাসাইমেন্ট হিসাবে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে মিয়ানমার সরকারের হয়ে গোপনে সক্রিয় থাকা রোহিঙ্গাদের ভেতরকার কিছু অপশক্তি। যার প্রথম সারিতে রয়েছে স্বদেশে যাওয়ার ঘোর বিরোধী উগ্রবাদী রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)। যাতে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের আর ফেরত নিতে না হয় সেজন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের মদদে এ সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া শুধু উগ্রপন্থি আরসাই নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চরমপন্থি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে মদদ দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে আল ইয়াকিন, আরএসও, ইসলামি মাহাত, সিভিল রাইটস ও মানবাধিকার ইস্যুতে আন্দোলন করা কয়েকটি সংগঠনও। আর এসব চরমপন্থি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার।
এ সংক্রান্ত বিস্তারিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইতোমধ্যে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি এ অপশক্তির সব চক্রান্ত প্রতিহত করাসহ এ বিষয়ে আরও বিশদ তথ্য বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক টিম এখন সরেজমিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কাজ করছে। ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি টিম ইতোমধ্যে ক্যাম্প এলাকায় তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘আন্ডার কাভার্ড’ কার্যক্রম জোরদার করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সোমবার বলেন, ‘রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ প্রত্যাবাসনের পক্ষেই কাজ করছিলেন। এ কারণে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। জড়িতদের কঠোর এবং কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি এখন দেশের সীমানা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। পিছিয়ে নেই রোহিঙ্গারাও। রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত অনলাইন মিড়িয়াগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বলছে, মিয়ানমার সরকারের দালাল আরসার হাতেই মুহিবুল্লাহ খুন হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র দাবি করেছে, রোহিঙ্গাদের কাছে আরসা নেতা হিসাবে পরিচিত সমি উদ্দিন ও সোনা মিয়ার নেতৃত্ব মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। মুহিবুল্লাহ হত্যার ঠিক আগ মুহূর্তে সমি উদ্দিন ও সোনা মিয়া ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকছে, এমন খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন রোহিঙ্গারা। ওই সময় রোহিঙ্গাদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাদের এ সংক্রান্ত কথোপকথনের একাধিক অডিও হাতে এসেছে।
এছাড়া খুন হওয়ার দুদিন আগে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ২৭ সেপ্টেম্বর এক অডিও বার্তায় নিজের জীবন নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন। অডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আরসা এখন মিয়ানমার সরকারের পক্ষে কাজ করছে। ক্যাম্পে অস্ত্র উঁচিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। তারা (আরসা) নাকি ৩১৩ জন সাহাবা সৃষ্টি করতে চায়। তবে ৯৫ শতাংশ রোহিঙ্গা আমার পক্ষে রয়েছে। কিন্তু আমার পাশে থাকা আব্দুর রহিমসহ মুরব্বিদের ভয় দেখিয় দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে কোনো সময় তারা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। এমন পরিস্থিতি হলে তো আমরা আর দেশে ফিরে যেতে পারব না। সবাই আমার জন্য দোয়া করেন।’ অডিওটি কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইতোমধ্যে কমবেশি প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। যাদের লক্ষাধিকের হাতে রয়েছে মিয়ানমারের সিম। এসব সিম ব্যবহার করে তারা ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক কেনাবেচা, অস্ত্র ও স্বর্ণের চোরাচালান, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি তাদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের দালাল বা এজেন্ট হিসাবে এখানে কাজ করছে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করছে। এ কাজটি সহজ করতে অর্থাৎ যাতে সব সময় নেটওয়ার্ক ভালো থাকে, সেজন্য সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সরকার এখন পর্যন্ত ১২টির মতো মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করে দিয়েছে। প্রয়োজনে আরও কয়েকটি টাওয়ার বসানো হবে। এছাড়া সেখানকার গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এসব ফোনে আড়ি পেতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করছে।
মিয়ানমার সীমান্তের হোয়াইক্যংয়ের তেরসা ব্রিজে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোনের ফ্রিকোয়েন্সি টাওয়ার। একটি টাওয়ার থেকে আরেকটির দূরত্ব আনুমানিক এক থেকে দেড় কিলোমিটার। মিয়ানমারে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দেশটির মংডু সীমান্তে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় এমপিটি (মিয়ানমার পেস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন) নামের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিকম প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১২টি টাওয়ার বসিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য রেজিস্টার্ড (নিবন্ধিত) সিম পাঠাচ্ছে তারা। অথচ ২০১৯ সালের আগে সেখানে কোনো টাওয়ারের অস্তিত্ব ছিল না।
উখিয়া পালংখালী ইউনিয়নের অন্তত ৯ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা মায়ানমারের এমপিটি সিম ব্যবহার করছে। বাকিরা ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির সিম।
মিয়ানমারের সিম এমপিটির স্থানীয় এক এজেন্টের কাছে এ সিমের অফার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বেশ কয়েকটি প্যাকেজ কেনার কৌশল বলেন। তবে প্যাকেজগুলোর দাম ছিল অবিশ্বাস্য রকম কম। মাত্র সাড়ে ১৫ টাকায় (বাংলাদেশি মুদ্রা) এক জিবি ইন্টারনেট, ২৬ টাকায় দুই জিবি, ৫২ টাকায় পাঁচ জিবি এবং ১৫৫ টাকায় ১০ জিবি ইন্টারনেট দিচ্ছেন তারা। এছাড়া মাত্র ৮৭ টাকায় সাত জিবি ইন্টারনেট, সঙ্গে ১০৫ মিনিটের অফার দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্যাকেজটি কিনতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
এদিকে কক্সবাজার জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে মুক্তিপণ চাওয়ার একাধিক ঘটনা উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তাদের বিপাকে পড়তে হয়েছে। কারণ এ সিমের নিয়ন্ত্রণ বিটিআরসির কাছে নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পের ১১ লাখ রোহিঙ্গার অর্ধেকের হাতেই রয়েছে মোবাইল ফোন। এ দেশের মধ্যে অনেকে রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করছে। কেউ আবার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ছাড়াই দেশের সিমকার্ড ব্যবহার করছে। তবে এটি কিভাবে সম্ভব হয়েছে সে প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম সোমবার বলেন, কয়েকটি কারণে মিয়ানমার সরকার এভাবে ওই এলাকার সীমান্তে টাওয়ার বসাতে পারে। প্রথমত, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকানো। যা ডলারের বিপরীতে তাদের দেশের রিজার্ভে যুক্ত হবে। এটা বিশাল একটা গোপন বাণিজ্যও বটে। দ্বিতীয়ত, কারা কিভাবে দেশে ফিরে আসতে চায়, সে তথ্য সহজে বের করা এবং সে মোতাবেক কাউন্টার ব্যবস্থা নেওয়া। এছাড়া সিমের কারণে প্রযুক্তির সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের ফোনালাপ রেকর্ড করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা। মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের যুক্ত করার চক্রান্তও থাকতে পারে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসির) চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার মঙ্গলবার বলেন, মিয়ানমার সরকার সীমান্তে যেসব টাওয়ার বসিয়েছে বলে বলা হচ্ছে তা নিয়ম অনুযায়ী তাদের সীমারেখার ভেতরেই বসিয়েছে। তাই প্রতিবাদ করার যৌক্তিকতাও কঠিন। আবার এ টাওয়ারের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতাও বিটিআরসির নেই। তবে মিয়ানমারের সিমকার্ডধারী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদিও জনবল সংকট ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।