নৈতিকভাবে মেনন এখন এমপি পদে থাকতে পারেন কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সেটা উনিই (মেনন) ভালো বলতে পারবেন। এবিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারিনা। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেকেই ইমোশনালি অনেক কিছুই বলেন। পরে বুঝতে পারেন, এটা বলা ঠিক হয়নি।’
গত ১৯ অক্টোবর বরিশাল নগরীতে ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা কমিটির সম্মেলনের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, ‘আমি নিজেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। তারপরেও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি- এই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদেও ভোট দিতে পারে না, উপজেলায়ও পারে না। তাহলে শেখ হাসিনা আপনি-আমি মিলে যে ভোটের জন্য লড়াই করেছি, ঘেরাও করেছি আজিজ কমিশনকে। আমরা ১ কোটি ১০ লাখ ভুয়া ভোটার-তালিকা ছিঁড়ে ফেলার জন্য নির্বাচন বর্জন করেছিলাম নমিনেশন জমা দেওয়ার পরেও। আজকে কেন আমার দেশের মানুষ, ইউনিয়ন পরিষদের মানুষ, আমার উপজেলার মানুষ, আমার জেলার মানুষ, আমার জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে না?’
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান মেননের এই বিস্ফোরক বক্তব্য ঝড় তোলে রাজনৈতিক অঙ্গনে। মেননের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মন্ত্রী হলে মেনন কি একথা বলতে পারতেন?’ মেননের বক্তব্য সম্পর্কে ১৪ দলের আরেক শীর্ষ নেতা ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে তার মন্তব্য সঠিক নয়। নির্বাচন হয়েছে, ভোটারও ছিল। কাজেই এ নির্বাচনকে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।’ মেননের বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ১৪ দলেও। জোটের বৈঠক করে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ইতোমধ্যে বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে মেনকে চিঠি দিয়েছেন। মেনন বলেছেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তিনি এই চিঠির ব্যাখ্যা দেবেন।
এছাড়া মেননের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এখন পর্যন্ত তক্কাতক্কি চলছে। ফেসবুকে অনেকেই স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছেন- এই বক্তব্য দেওয়ার পর মেননের উচিত এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করা।
সংসদ থেকে মেননের পদত্যাগ করা উচিত কি-না কিংবা তিনি এমপি পদে বহাল থাকতে পারেন কি-না, এব্যাপারে দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক গতকাল সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্যের কোনো লিগ্যাল দিক নেই। নির্বাচন হয়েছে কী হয়নি সেটা তো প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয়। একজন সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন নির্বাচন হয়নি বললেই তো নির্বাচন বাতিল হয়ে যাবে না। আবার উনি যদি বলেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে সেটিও প্রমাণ হয়ে যাবে না। বিষয়টা হচ্ছে- এখানে তার বক্তব্যের আইনি দিকটা মূখ্য নয়। কেননা কোনো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একটা মন্তব্যে নির্বাচন বেআইনি হবে না। একইভাবে একটি কারসাজির নির্বাচনকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করলে সেটি সুষ্ঠু নির্বাচন বলে বিবেচিত হবে না। তবে নীতি-নৈতিকতার বিচারে এই বক্তব্যের পর সংসদ সদস্য পদ থেকে মেননের ইস্তফা দেওয়াটা একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হতো।’ বিশিষ্ট এই আইনজ্ঞ আরও বলেন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, নীতি-নৈতিকতা মেনে চলা রাজনীতিকের আজকাল বড়োই আকাল।
শাহদীন মালিকের মতোই প্রায় অভিন্ন মত দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার খায়রুল আলম চৌধুরীও বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ এমপি নির্বাচিত হন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেউ ভোট দিতে না পারলে কিংবা ভোটগ্রহণে জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে সেক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পেতে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালসহ আইনি নানা পদক্ষেপ রয়েছে। যদি সেরকম কিছু না ঘটে তাহলে সেটি আইনি কোনো ভিত্তি পায় না। কোনো একজন মুখে বললেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় না, কিংবা মানুষ ভোট দিতে পারেনি-এটা প্রমাণ হয়ে যায় না। কারও কথায় তো নির্বাচন অবৈধ হয়ে যায় না, কারও কথায় দেশও চলতে পারে না। আইন চলে আইনের মতো করে।’
ব্যারিস্টার খায়রুল বলেন, ‘রাশেদ খান মেনন নিজেই নিজের জন্য সংকট তৈরি করেছেন। আইনি দিক দেখলে- এই বক্তব্যের জন্য তার সংসদ সদস্য পদ শূন্য হচ্ছে না। তবে নৈতিকতার বিচারে এই ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে-সঙ্গেই তার উচিত ছিল এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করা। আমরা যদি ধরেও নিই যে, মেনন সাহেবের এলাকায় (ঢাকা-৮ আসনে) মানুষ ভোট দিতে পারেনি, তাহলে তিনি তা নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিন্তু সারাদেশেই মানুষ ভোট দিতে পারেনি- এটা তো বলার অধিকার তার নেই। কারণ তিনি তো সারাদেশের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন না, তাহলে সাক্ষ্য দেবেন কীভাবে! নিজে এমপি হয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। আবার একই নির্বাচন নিয়ে এই ধরনের বক্তব্য নৈকিতার চরম অধপতনের উদাহরণ।
বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে পরদিনই (২০ অক্টোবর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আগেরদিনের অবস্থান থেকে সরে মেনন দাবি করে বলেন, ‘আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ উপস্থাপন না করে অংশ বিশেষ উত্থাপন করায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। একাদশ সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়। আমার বক্তব্য সম্পর্কে গণমাধ্যম ভুল বার্তা দিয়েছে।’ মেনন এই দাবি করলেও তারা বক্তব্যের ভিডিও ইউটিউব ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এখনও রয়ে গেছে। এমনকি, তিনি নিজেও পরবর্তীতে কখনও দুঃখপ্রকাশ করেছেন, কখনও বলেছেন- মুখ ফসকে এই মন্তব্য বের হয়ে গেছে।
এখন সংসদ সদস্য পদে মেননের বহাল থাকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে উত্থাপিত প্রশ্ন সম্পর্কে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাশেদ খান মেনন যে বক্তব্য দিয়েছেন আইনগতভাবে সেবিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার নেই। জাতীয় নির্বাচনের পরে নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন যা বলেছে, মেনন তার ঠিক উল্টো কথা বলেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া যাবে না-এমন কোনো বিধান কোথাও নেই।’ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘কিছু লোক তো মেননকে ভোট দিয়েছেন। সেই হিসাবে উনি এমপি পদে বৈধ। তবে নির্বাচনে জনগণের যেভাবে ভোট দেওয়ার কথা ছিল, জনগণ সেভাবে ভোট দিতে পারেনি। মেননের বক্তব্য অনুযায়ী, মেজরিটি লোক বিগত সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি।’
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, ‘রাশেদ খান মেনন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিগত নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কোনো কারণে ওয়ার্কার্স পার্টিকে জোট থেকে বহিস্কার বা বাদ দেওয়া হলে তখন আইনি সংকট তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্পিকারকে চিঠি দিয়ে নৌকা প্রতীক প্রত্যাহারের বিষয়টি অবগত করা হলে, সংসদ সচিবালয় থেকে বৃহত্তর শুনানির জন্য নির্বাচন কমিশনে পাঠানোর সুযোগ আছে। তবে বিষয়টি জটিল এবং উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াবে।’
প্রসঙ্গত, কারও সংসদ সদস্য পদ শূন্য হওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ৬৭(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হইবে যদি তাঁহার নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে নব্বই দিনের মধ্যে তিনি তৃতীয় তফসিলে নির্ধারিত শপথগ্রহণ বা ঘোষণা করিতে ও শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিতে অসমর্থ হন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ মেয়াদ অতিবাহিত হাইবার পূর্বে স্পিকার যথার্থ কারণে তাহা বর্ধিত করিতে পারিবেন।’ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।’ এছাড়া সংসদ সদস্য পদ শূন্য হওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ৬৭(১)(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংসদের অনুমতি না লইয়া একাধিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিত থাকিলে।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি উল্লেখ করে নিজেকে এর সাক্ষী হিসেবে দাবি করায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকতে পারেন কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও এখন এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ্যের মনে। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা বলছেন, আইনি প্রশ্ন এখানে মূখ্য নয়। কারণ আইন ও সংবিধান ধরলে নির্বাচন সংক্রান্ত এই ধরনের বক্তব্যের জন্য ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচিত রাশেদ খান মেননের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ নৈকিতার প্রশ্ন। জনগণ ভোট দিতে পারেনি- তা প্রমাণের পক্ষে নিজেকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানোর কারণে নীতি-নৈতিকতার বিচারে তার সংসদ সদস্য পদ থেকে সরে দাঁড়ানো সমীচীন হবে।এবিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম গতকাল শনিবার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাংবিধানিক দায়িত্ব। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচিত হওয়ার গেজেট প্রকাশের আগ পর্যন্ত যে কোনো বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকে কমিশনের। নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার গেজেট প্রকাশের পর কমিশনের আর কিছুই করার থাকে না। তিনি বলেন, নির্বাচিত সংসদ সদস্যের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তা হতে হবে সংসদ সচিবালয়ের মাধ্যমে। নির্বাচিত হওয়ার পরে কোনো এমপি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন- এমন কোনো বিষয়ে সংসদ সচিবালয় থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠালে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।