মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহককে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার নামে ভয়ংকর ফাঁদ পেতেছিল ‘র্যাপিড ক্যাশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অ্যাপটি ইনস্টল করার পরপরই গ্রাহকের মোবাইলের ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও, ফোন নম্বর, ফেসবুকসহ সব ব্যক্তিগত তথ্য চলে যেত চক্রটির কাছে। পরে তারা সেই তথ্য বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিয়ে নিত মোটা অংকের টাকা।
এ ছাড়া রেজিস্ট্রেশনের পর লোন নিয়ে গ্রাহকরা পড়তেন বিপদে। দুই-একদিন পরই শুরু হতো সুদ আদায়ের তাগিদ। ফোন দিয়ে ঋণের কিস্তি ও চড়া সুদ পরিশোধ করতে বলা হতো। কেউ সেই সুদ দিতে না পারলে তাকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হতো।
রাজধানীর উত্তরায় মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে অ্যাপটির মালিক মাহেরসহ ২৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। গ্রেফতারদের মধ্যে ১১ জন তরুণী রয়েছেন। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়িতে বসে ‘র্যাপিড ক্যাশ’ এই কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।
এটিইউ কর্মকর্তারা জানান, র্যাপিড ক্যাশ নামের ওই অ্যাপটিতে রেজিস্ট্রেশনের পর পরই এর ব্যবহারকারীকে ৫০০ বা ১ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হতো। আর ওই দিন থেকে টাকার ওপর প্রায় ১০০ টাকা হারে সুদ বাড়তে থাকে। ঋণ দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই পরিশোধ করতে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দেয় চক্রের সদস্যরা। কোনো গ্রাহক যদি উচ্চ হারের সুদ প্রদানে অস্বীকৃতি জানাতেন তাহলে তাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইলিং শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয় তথ্য ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করা হতো। কোনো গ্রাহক সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের পরও তাদেরকে আবারো ঋণ নিতে বাধ্য করা হতো। কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
এই চক্রের মূলহোতা মহিউদ্দিন মাহি। তিনি পড়াশোনা করেছেন চীনে। দেশে ফিরে দুই চীনা নাগরিকের সহায়তায় নিজের মেধা আর বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে বানিয়েছেন প্রতারণার ফাঁদ ‘র্যাপিড ক্যাশ’ নামে একটি অ্যাপ। শুধু দেশে নয়, ভারত ও পাকিস্তানেও এই অ্যাপ ব্যবহার করে চলছিল প্রতারণা। তবে তারা খুব বেশি এগোতে পারেনি। ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।
বুধবার মহিউদ্দিন মাহির এই চক্রটি সম্পর্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে এটিইউ। দুপুরে রাজধানীর বারিধারায় অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির সাইবার ক্রাইম উইংয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, র্যাপিড ক্যাশ একটি মোবাইল ফোন অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ৫০০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিত চক্রটি। সহজে ঋণ পাওয়ার আশায় মানুষও অ্যাপটি নিজেদের মোবাইলে ডাউনলোড করত। আর তখনই শুরু হতো বিপত্তি। এই অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে থাকা ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য হাতিয়ে নিত তারা। পরে ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে করা হতো টাকা আদায়। এভাবে কয়েক দিনের মধ্যে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
সম্প্রতি রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় এক ভুক্তভোগী চক্রের হাতে প্রতারিত হয়ে অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে মামলাটির তদন্তে নেমে চক্রটির সন্ধান পায় অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের একটি কল সেন্টারে অভিযান চালিয়ে এর পরিচালক মহিউদ্দিন মাহিসহ ২৬ জনকে আটক করা হয়। তবে এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড দুই চীনা নাগরিককে পাওয়া যায়নি। এ সময় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু কম্পিউটার ও ল্যাপটপ জব্দ করা হয়।
এসপি ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, চক্রটির সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করা মহিউদ্দিন মাহি চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পড়াশোনা করেছেন। তিনি ভালো চীনা ভাষা বলতে পারেন। এই সুযোগে তারা এই প্রতারণাটি করে আসছিল। বাংলাদেশে বসে তারা প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকদের একইভাবে ঋণ দিয়ে প্রতারণা করত। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদায় করত।
আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ফারহানা ইয়াসমিন আরও বলেন, সহজে ঋণ দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলত চক্রটি। এরপর মোবাইলের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলার নামে ভোটার আইডি ও ছবি নিত। গ্রাহকেরা এই কাজগুলো করার সময় চক্রটি কৌশলে মোবাইলের কল লিস্ট, গ্যালারির ছবি, ভিডিওসহ সব তথ্য হাতিয়ে নিত। এরপর ঋণ দেওয়ার পর উচ্চসুদে আদায় শুরু করত। কেউ দিতে আপত্তি জানালে তাকে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের হুমকি দিত। এই অ্যাপটি বানিয়েছে চীনারা। তারা এটাকে এভাবেই বানিয়েছে যে ডাউনলোড করলেই সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়া যেত।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, অভিযানে আমরা দেখতে পাই একটি বাসার ভেতরে গোপনে তারা এ কাজ করছেন। অফিসে কাজ করা তরুণ-তরুণীরা হিন্দি ও উর্দু ভাষায় ভারতীয় এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। ভারত ও পাকিস্তানে একই অ্যাপ ভিন্ন নামে লোন দিচ্ছে। একইভাবে তাদের সঙ্গেও ঋণ দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। ৫০০ টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েছে তারা। এর বিপরীতে তারা ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা আদায় করত। এ কাজ করা প্রত্যেক কর্মীকে ১২-১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হতো। পাশাপাশি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারলে বোনাস দেওয়া হতো। এর মাধ্যমে কর্মীরা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পেত। আমরা ধারণা করছি, এই চক্রের আরও এমন কলসেন্টার রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, মাহি উচ্চশিক্ষিত। তিনি চীনা ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ। ক্রিপ্ট কারেন্সি কয়েন ব্যবসা সম্পর্কে তিনি জানেন। পাশাপাশি তিনি কথায় অনেক পটু। কিভাবে মানুষকে ভয় দেখাতে হবে, কী বললে টাকা আদায় করা যাবে তিনি সব জানেন। এমনকি তার কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করতেন গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে। টাকা আদায় করতে না পারলে কর্মীদের বের করে দিতেন। তিনি জানান, গ্রেফতার প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।