যাত্রীর জীবন হাতে গতির খেলা

main-qimg-fc9532ab3c49812809da4929cdd9f1fc-lq

গাবতলী বা মহাখালী এলাকায় পরিবহন শ্রমিকদের কোনো চায়ের আড্ডায় কান পাতলে শোনা যাবে ‘পাড়াপাড়ি’, ‘চাপ’, ‘বাউলি’র মত কতগুলো শব্দ। শুনতে যতই মজার হোক, ঘটনাগুলো নিরীহ নয় মোটেও।

ঢাকা থেকে পিরোজপুর যাওয়ার পথে গত ২৯ মে বরিশালের উজিরপুরে যমুনা লাইন পরিবহনের একটি বাস গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ১০ জন নিহত হয়।

বাস কোম্পানির দায়িত্বশীলরা বলছেন, আরেকটি বাস ওভারটেক করার সময় ‘চাপ’ দিলে যমুনার চালক আরিফ খান ‘সামলাতে পারেননি’, চলন্ত বাস বাঁয়ে থাকা গাছে ‘মেরে দেন’। তাতেই প্রাণক্ষয়।

আরেকটি গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে বাস যখন দ্রুত গতিতে একাধিকবার লেইন বদল করে, পরিবহন শ্রমিকরা তাকে বলেন ‘বাউলি’।

সামনের দিক থেকে আসা কিংবা ওভারটেকিংয়ের পর পেছনের গাড়িকে পর্যাপ্ত জায়গা না দিয়ে রাস্তার একপাশে সরে যেতে বা থেমে যেতে বাধ্য করাকে তারা বলেন ‘চাপ দেওয়া’।

যাত্রীদের ঝুঁকিতে ফেলে মহাসড়কে বাস নিয়ে চালকদের এই আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা অনেক কিছু করেও থামানো যাচ্ছে না।

বাস মালিকরা বলছেন, বাসে ‘গভর্নর্স সিল’ লাগিয়ে, চালকদের শাস্তি দিয়ে, প্রশিক্ষণসহ সব রকম চেষ্টা করেও চালকদের গতি নিয়ন্ত্রণে তারা সফল হতে পারেননি।

বাংলাদেশ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহর ভাষায়, “যতক্ষণ না কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। আর গতি নিয়ন্ত্রণ হলেই দেখবেন দুর্ঘটনা অর্ধেকে নেমে গেছে।”

অন্যদিকে পুলিশ বলছে, বাস মালিকদের কথা ও কাজে ‘মিল নেই’।

হাইওয়ে পুলিশের এসপি আলী আহমদ খানের কথায়, “বাস মালিকদের সঙ্গে আমরা প্রতি মিটিংয়েই বলি- আপনারা গভর্নর্স সিল লাগান। কিন্তু তারা সেটা করছেন না। আমরা যদি রাস্তার মাঝখনে দাঁড়িয়ে এসব করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এবং সেটা বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক হবে না।”

ভয়ঙ্কর বাসযাত্রা

২০১৮ সালে বাংলাদেশের দূরপাল্লার একটি বাসের যাত্রী হয়েছিলেন জার্মান ইউটিউবার স্টিভ লং। তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত সেই বাসযাত্রার ভিডিওতে দেখা যায়, শ্যামলী পরিবহনের বাসটি ক্রমাগত হর্ন বাজাতে বাজাতে ডানে-বাঁয়ে এঁকে-বেকে দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতি অভ্যস্ত নিয়মিত বাসযাত্রীদের কেউ কেউ এর মধ্যে ঘুমাতে পারলেও স্টিভ ঈশ্বরকে স্মরণ করছিলেন। বাস থেকে নামার পর তার মন্তব্য, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এখনও বেঁচে আছি। আমি আমার প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছি।”

ইউটিউব ও ফেইসবুক চ্যানেলে ‘বাসের রেস’, ‘সেরা বাউলি’, ‘বাউলি মাস্টার’ ইত্যাদি নামে বহু ভিডিও রয়েছে। দেশের যে তরুণেরা এসব ভিডিও প্রকাশ করেছেন, তারা অবশ্য স্টিভের মতো ভয়ে ছিলেন না।

নিছক আনন্দের জন্যই এরকম ‘বাস রেসের’ ভিডিও তারা তৈরি করছেন, যদিও সেটা তার নিজের এবং আরও অনেকের জন্য বিপজ্জনক ছিল।

তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বাস শ্রমিকদের দ্রুতগতিতে চালাতে উসকে দেওয়ারও অভিযোগ আনছেন মালিকরা। এ কারণে কয়েকটি বাস কোম্পানি বাসের ভেতরে ভিডিও ধারণ না করার বিজ্ঞপ্তিও টাঙিয়ে দিয়েছে।

এরকম বাসযাত্রায় কী ঘটে, তার বিবরণ জানা গেল ঢাকা-ঠাকুরগাঁও পথের নিয়মিত বাস যাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা আহসান হাবীবের কথায়।

তিনি বললেন, “বাসগুলো এমনভাবে ডানে-বামে বাউলি দিতে থাকলে ভেতরের যাত্রীদের অবস্থা হয় টিনে রাখা মুড়ির মতো। ঠিকমত ধরে না বসলে কখনো কখনো সিট থেকে উল্টে পড়ে যাওয়ার দশা হয়। না যায় ঘুমানো, না যায় শান্তি করে বসা।

“এসি বাসগুলো একটু বেটার, নন এসি প্রত্যেকটা বাসেরই এমন বেপরোয়া গতি। নন এসিতে চড়ে রাতভর এমন ভয়ঙ্কর যাত্রার পর দিনে কোনো কাজ করা যায় না।”

গত ৫ জুলাই ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাওয়ার সময় এমনই অভিজ্ঞতা হয় ‘আহাদ পরিবহনের’ একটি বাসে। ঢাকা থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত পুরো রাস্তা থেমে থেমে যাত্রী তুলতে তুলতে গেলেও এরপর শুরু হয় গতির ঝড়। ভাঙা রাস্তার মধ্যেও চালক গতি কমাচ্ছিলেন না।

মাঝে-মধ্যেই সজোরে ব্রেক করছিলেন চালক। গাড়ির সিট থেকে কুশন খুলে পড়ছিল। ছাদে লাগানো ফ্যানগুলো এদিক-ওদিক বাড়ি খাচ্ছিল। তবে কোনদিকেই চালকের ভ্রুক্ষেপ ছিল না।

‘পাড়াপাড়ি’ থেকে দুর্ঘটনা

গত ২৯ মে বরিশালের উজিরপুরে দুর্ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যুর পর থেকে যমুনা লাইন পরিবহনের বাসটির চালক আরিফ খান পলাতক। তবে কোম্পানির পরিচালক সাইদুল ইসলাম পরে ওই বাসের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

তাদের তথ্যের ভিত্তিতে সাইদুল দাবি করছেন, আরেকটি বাস যমুনা লাইনের ওই বাসটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ফেলে।

“দুর্ঘটনার সময় ওর গতি ছিল ৬৫ থেকে ৭০ (কিলোমিটার/ঘণ্টা)। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। এ সময় আরেকটা বাস ওকে ওভারটেক করতে গিয়ে বাঁয়ে চাপ দিলে সংঘর্ষ এড়াতে গাড়ি কিছুটা বাঁয়ে নিলেও আর রাস্তায় উঠতে পারেনি। একেবারে গাছের সঙ্গে মেরে দেয়।”

যমুনা লাইন পরিবহনের এই পরিচালক বলেন, তাদের প্রত্যেকটি গাড়িতে জিপিআরএস প্রযুক্তি লাগানো আছে। প্রত্যেক ট্রিপের আগে তারা চালকদের সাবধান করে দেন গতিসীমার মধ্যে থেকে গাড়ি চালানোর জন্য। তবে চালকদের অনেকেই কথা শোনেন না। ‘পাড়াপাড়ি’ করে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান।

পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দুদিন পর ২৯ জুন রাতে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের আব্দুল্লাহপুর এলাকায় আরেকটি বাসকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওভারটেক করতে গিয়ে উল্টে যায় সাকুরা পরিবহনের একটি এসি বাস। পেছনের আরেকটি বাস থেকে এক যাত্রীর ধারণ করা সেই ঘটনার ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

তাতে দেখা যায়, বাসটি খুবই বিপজ্জনকভাবে একাধিক বাঁক নিয়ে সামনের আরেকটি বাসকে ওভারটেক করতে চাইছিল। এভাবে বারেবারে বাঁক বদল করে চলতে গিয়ে সামলাতে না পেরে এক পাশে কাৎ হয়ে উল্টে পড়ে কিছুটা ছেঁচড়ে যায় বিশালাকার বাসটি।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলছেন, গাড়ির গতি সামান্য বাড়লে মানুষের বাঁচার সুযোগ কমে যায়। কিন্তু মহাসড়কগুলোতে ঘণ্টায় ৮০-৯০ কিলোমিটারের নিচে কোনো গাড়ি চলাচল করে না।

চেষ্টা করেও ব্যর্থ?

চালকদের অতিরিক্ত গতিতে চালানোর ‘বদঅভ্যাস’ দূর করতে না পারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন দেশের অন্যতম বড় অপারেটর এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, “বাস দুর্ঘটনাগুলো বেশিরভাগ যে কারণে হয়, সেটা হল এই ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং। এ রকম বহু ঘটনা আমি দেখছি। এছাড়া পথচারীর কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।”

তিন দশক ধরে পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত এনায়েত উল্যাহ বলেন, “অনেক চালক আছেন, যারা অনেক গতিতে গাড়ি চালাতে পছন্দ করেন। তবে এটাতে এমন না যে তারা দ্রুত চালিয়ে একটা ট্রিপ বেশি চালাতে পারবেন। দূরপাল্লায় জোরে চালাক আর আস্তে চালাক, ট্রিপ তো একটা বেশি হবে না। তাও তারা জোরেই চালাবেন।

“জোরে গাড়ি চালিয়ে লস ছাড়া কোনো লাভ নেই। দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি থাকে। গাড়িগুলো দ্রুত লক্কড়-ঝক্কড় হয়ে যায়, গাড়ির মেনটেইন্যন্স খরচ বেড়ে যায়।”

গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গাড়ির ইঞ্জিনে ‘গভর্নর্স সিল’ দিলেও চালকরা তা ভেঙে ফেলে দাবি করে তিনি বলেন, “অনেক গাড়িতে আমরা টোটাল স্পিড গভর্নরটাকে একটা কভার দিয়ে ঢেকে ওয়েল্ডিং করে দিয়েছি। তারা সেটাও ভেঙে ফেলেছে।”

ডিজেল ইঞ্জিনের তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় একটি যন্ত্রাংশ হল ‘গভর্নর’। এর স্ক্রু ঘুরিয়ে ডিজেল সরবরাহ কমিয়ে দিলে ইঞ্জিনের জোর কমে যায়, তাতে উচ্চ গতি তোলা সম্ভব হয় না।

এনায়েত উল্যাহ বলেন, “… শোনেন মালিকরা বহুদিন থেকে অনেক কিছু করেও চালকদের জোরে চালানোর স্বভাব বদলাতে পারেনি। মালিকরা যত যাই করুক, গাড়ির ব্যবসাটা পুরোপুরি নির্ভরশীল ড্রাইভার ও শ্রমিকদের ওপর।”

কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ ছাড়া চালকদের এ আচরণ বদলানোর ‘পথ দেখেন না’ জানিয়ে মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, “আমি আমার সকল রকম চেষ্টা কইরা দেখছি। হাইওয়ে পুলিশ যতক্ষণ না খুব কঠিন আর কঠোর হবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”

তার প্রশ্ন: “এগুলা কেন হাইওয়ে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করবে না? কেন হাইওয়ে পুলিশ এখানে কঠোর হচ্ছে না। আজকাল তো বিদেশে স্পিড কন্ট্রোল করার বহু ধরনের ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে কেন তারা সেগুলো ব্যবহার করছেন না।

“হাইওয়েতে গতি নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম বসানো হোক। দুই-তিন মাইল পরপরই পুলিশের পোস্ট থাকুক, দ্রুতগতির যানবাহনগুলোকে ধরে ধরে ফাইন করা শুরু করুক। পুলিশ অ্যাকশন শুরু করলে অবশ্যই পরিস্থিতি পাল্টাবে।”

যেসব বাস রাস্তায় নেমে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্যে এনায়েত উল্যাহর এনা পরিবহন আছে সামনের সারিতে।

তবে তার দাবি, নিজের কোম্পানির চালকদের ‘স্বভাব পাল্টানোর জন্য’ তিনি একটি দল নিযুক্ত করেছেন। ব্র্যাকের একজন সাবেক ট্রেইনারকে এনেছেন। প্রতি মাসে তিনি ঢাকায় ও বিভিন্ন স্টেশনে চালকদের প্রশিক্ষণ দেন। তাতে ‘কিছু ইতিবাচক ফল’ পাওয়া যাচ্ছে।

একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে হানিফ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধেও। কোম্পানির চেয়ারম্যান কফিলউদ্দীনও চালকদের ‘বেপরোয়া’ মনোভাবের কারণে ক্ষতি হওয়ার কথা জানালেন।

“জোরে চালাইলে তো আমাদের তেল বেশি যায়, গাড়ির ক্ষতি, সবদিক দিয়েই ক্ষতি। তাও ড্রাইভারগো বুঝায়া পারি না। আমরা তো দুইটা লোকই রাখছি ড্রাইভারদের বুঝানোর জন্য। এহন কোনো ড্রাইভারের বিরুদ্ধে রাফ চালানোর কমপ্লেইন আসলে আমরা তারে বসায়া রাখি, ডিউটি দিই না। পরপর তিনবার একই কমপ্লেইন আসলে তারে চাকরি থেকে বাদ দিই।”

তবু তাদের সামলাতে না পারার কথা জানিয়ে কফিলউদ্দীন বলেন, “দুর্ঘটনা হইলে ক্ষতিতো মালিকের হয়, চালকের তো আর হয় না। বড় দুর্ঘটনা হইলে তাদের কেউ আহত হন, আাবর অনেক ক্ষেত্রে জানটাও যায়।

“আমরা তাদের (চালকদের) সাথে মিটিং করি, তাদের বুঝাই, তাদের ট্রেনিং দেওয়াই। আমরা তো আমাদের সম্পদ রক্ষার অনেক রকম চেষ্টা করি। বলি, কম স্পিডে গাড়ি চালাও। কারণ বেশি স্পিডে গাড়ি চালাইলে তো আমাকে টাকা বেশি দিবে না কেউ। ভাড়াতো একই।… তারপরও দুই-চাইর জন স্টিয়ারিংয়ে বসে মাথা গরম কইরা।”

কফিলউদ্দীনও ‘কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া’ এ সমস্যার সমাধানের পথ দেখছেন না ।

“রাস্তায় যদি পুলিশের স্পিড ক্যামেরা সব সময়ের জন্য থাকে, তাহলে খুব ভালো হয়। কেউ বেশি স্পিডে চালালে অটোমেটিক মামলা হবে। প্রথম প্রথম একবার-দুইবার হয়তো আমাদের জরিমানার টাকা দেওয়া লাগবে। পরে আমরা বলব যে না- আমরা আর জরিমানার টাকা দিব না। তাহলেই ওরা সতর্ক হবে। এটা হল একমাত্র পথ। ফুল কন্ট্রোল করতে হলে পুলিশের উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব না।”

ইলিয়াস কাঞ্চনও ‘একমত’

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চনও আইনের কঠোর প্রয়োগ চান। তার যুক্তি, গতি যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে দুর্ঘটনা হলেও ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। তাদের দীর্ঘদিনের স্লোগান, যত গতি তত ক্ষতি।

খন্দকার এনায়েত উল্যাহর আমন্ত্রণে এনা ট্রান্সপোর্টের চালকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “সেদিন তিনি আমার সামনে ড্রাইভারদের অনেক বকাবকি করলেন। কোম্পানি থেকে গাড়ির গতি আশির (কিলোমিটার/ঘণ্টা) মধ্যে রাখার জন্য গভর্নর্স সিল করে দেয়। চালকেরা সেটা ভেঙে ফেলে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালায়।

“একমাত্র সড়ক পরিবহন আইনের জরিমানাগুলো যতোক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এদের থামানো যাবে না।”

এ আইনে গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা বা জরিমানা করার যে বিধান আছে, তারও সমালোচনা করলেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চন।

তার ভাষায়, এতে করে চালকের দোষ পুরোপুরি মালিকের ঘাড়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে চালক যে ভুল করছে, সেটা তার বোধগম্য হচ্ছে না।

“কারণ তার তো কোনো শাস্তি হচ্ছে না, ক্ষতিও হচ্ছে না। কাজেই তার শুধরানোর প্রশ্নও আসছে না। একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে তুলে এরকম ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও নাই।”

‘ধৈর্য্য রাখা কঠিন’

গত সপ্তাহে গাবতলীতে একটি চায়ের দোকানে কথা হয় কয়েকজন বাস চালকের সহকারীর সঙ্গে। তাদের একজন শাহ আলম গর্ব কলে বললেন, “আমার ওস্তাদে বাউলির ওস্তাদ। গাড়ি সামনের গাড়ির বাম্পারে ঠেকাইয়া ডানে কাইটা শা কইরা বায়ে নিয়া বারায় যায়গা।”

আরেকজন আব্দুল হান্নান বেশ নাটকীয়ভাবে বলেন, “খেলা হবে, বাম্পারে বাম্পারে।”

তবে চালকদের মধ্যে অভিজ্ঞরা সাবধানে চালানোর পক্ষপাতী। তবে তারাও স্বীকার করেন, সড়কে ওঠার পর তাদের জন্য ধৈর্য্য ধরে রাখা ‘কঠিন’। অথচ তারা সবাই জানেন, জোরে চালালে গাড়ির ইঞ্জিন, ব্রেক, সিট, অন্দরসজ্জা সবকিছুরই ক্ষতি হয়।

মো. মামুন একটি কোম্পানির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চালান। তার দাবি, গতির নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোটা অনেক যাত্রী পছন্দ করেন না।

“কোন কোন যাত্রী আছেন একটু রয়ে-সয়ে চালাতে গেলেই উঠে এসে গালিগালাজ করে। ‘গরুর গাড়ি’ বলে, আরও জোরে চালাতে বলে। প্রতি গাড়িতে ৪-৫ জন করে এরকম যাত্রী থাকে।”

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বাস চালক এমদাদ বললেন, “বাংলাদেশের রাস্তার যে পরিস্থিতি, তাতে পাড়াপাড়ি করলে বিপদে পড়তে হইবই, মাস্ট। কিন্তু বাংলাদেশের এখন বেশিরভাগ ড্রাইভারই এসব বোঝে না। এরা বোঝে কীভাবে জোরে যাব, কীভাবে অন্যদের আগে যাব, কীভাবে চাপ দিয়ে অন্যকে ফালায় দেব- এসব।

“শান্তভাবে যে যাত্রীদের নিয়ে গন্তব্যে যাওয়া যায়, এই জ্ঞানটা তাদের কেউ দেয় না। যদি তারা গাড়ির দিকে, মালিকের দিকে, যাত্রীদের দিকে এবং নিজের চিন্তাটুকুও করে, তাহলে আর এভাবে চালাতে পারবে না।”

পুলিশের আঙুল মালিকদের দিকে

হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন গাজীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া) আলী আহমদ খান।

তার দাবি, বাস মালিকরা যে গভর্নর্স সিল লাগানোর কথা বলছেন, সেটা ‘অনেকাংশেই সত্য নয়’।

“গভর্নর্স সিল আসলে লাগানোই থাকে না। এটা তারা সবাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে। তারা বলে হাইড্রলিক হর্ন নেই, কিন্তু গাড়িগুলোতে হাইড্রলিক হর্নও থাকে। তাদের কথা ও কাজের কোনো মিল নেই।

“মূল কথা হল এটা- তারা এক ড্রাইভারকে দিয়ে ১২ ঘণ্টা থেকে পারলে ২৪ ঘণ্টাই ডিউটি করায়। এটাও দুর্ঘটনার একটা কারণ।”

পুলিশ কর্মকর্তা আলী আহমদ বলেন, “সব গাড়ির ফিটনেস যদি আমরা রাস্তায় চেক করি, তাহলে তো রাস্তায় বিশাল কিউ হয়ে যাবে। তখন আবার কেউ বলবে রাস্তায় পুলিশ হয়রানি করছে।… মাঝে মাঝে আমরা যে চেকপোস্ট বসাই, তখনি মানুষ বিরক্ত হয়।”

“আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে যেটা করি, র‌্যানডম চেক করি। র‌্যানডম মানে ১০০টা গাড়ি চললে আমরা হয়ত পাঁচটা গাড়িকে স্পিডগান দিয়ে চেক করে মামলা দিই বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিই।… এটা তো প্রতিটা পয়েন্টে করা সম্ভব না। একমাত্র মেশিন বা স্পিড ডিটেক্টর ক্যামেরা দিয়ে যদি আমরা করতে পারি, সেটা সম্ভব। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে এরকম ব্যবস্থা হচ্ছে, যাতে সিসি ক্যামেরার মধ্যে গতি শনাক্ত করার ব্যবস্থা থাকবে।”

Pin It