যেভাবে ধরা পড়লেন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তরা

image-242871-1620481660

অবশেষে আশঙ্কাকে সত্যিতে পরিণত করে করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ভারতের কাছের জেলা যশোরেই শনাক্ত হলো। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে শুক্রবার (৭ মে) রাতের ল্যাব পরীক্ষায় করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরণ শনাক্ত করা হয়েছে।

১৬ জন ভারত ফেরত রোগীর নমুনা পরীক্ষা করে ৩ জন রোগীর করোনা পজিটিভ আসে। পজিটিভ তিনজনের মধ্যে দুজনের শরীরে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরণ শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন ১৬-১৭ বছর বয়সী কিশোরের বাড়ি খুলনা জেলায় এবং অপরজন সাতক্ষীরা জেলার ৪০ বছর বয়সী নারী।

গত ৬ মে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল থেকে তাদের নমুনাসমূহ যবিপ্রবির ল্যাবে পাঠানো হয়। তবে ভারতীয় ধরণ শনাক্তের বিষয়টি যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান, সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু হাসান জানেন না বলে বিকাল সোয়া ৫টায় ইত্তেফাককে জানান।

জেলা প্রশাসক জানান, তারা ভারত ফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিয়ে গলদঘর্ম অবস্থায় আছেন। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপারে কেউ তাদের কিছু জানায়নি। সিভিল সার্জন বলেন, যবিপ্রবির ল্যাবে কতজন পজিটিভ বা নেগেটিভ, সেই তথ্য জানানো হয়। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কোনো তথ্য তিনি জানেন না।

যবিপ্রবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ভারত ফেরত করোনার রোগীর নমুনায় ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ল্যাবে কিছু সিকোয়েন্স করে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখন পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করার প্রক্রিয়া চলছে। বিষয়টি আমরা আইইডিসিআরকে (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) জানিয়েছি। পাশাপাশি যশোর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও বিষয়টি অবহিত করেছি।

যবিপ্রবির জিনোম সেন্টারে শুক্রবার রাতে সেন্টারের সহযোগী পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদের নেতৃত্বে একদল গবেষক সিকোয়েন্সির মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় এ ধরণ শনাক্ত করেন। গবেষণাটি সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন যবিপ্রবির উপাচার্য ও জিনোম সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন।

ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ল্যাবে আসা নমুনায় প্রথমে করোনা আছে কী নেই সেটা শনাক্ত করা হয়। পজিটিভ হলে তা সিকোয়েন্স করা হয়। আর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এ সিকোয়েন্স করার সক্ষমতা একমাত্র যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরই রয়েছে।

যবিপ্রবি’র অনুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদ ইত্তেফাককে জানান, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বি১.৬১৭.২ নামের ধরণটি জিনোম সেন্টারে শনাক্ত করা হয়েছে। ভ্যাকসিন পরবর্তী ‘সেরাম এবং মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি’ এ ধরণকে কম শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে পারে।

প্রফেসর জাহিদ উল্লেখ করেন, যদিও শনাক্ত হওয়া ভেরিয়েন্টটি ডাবল মিউটেশন নয়। তবে যেহেতু একটি এসেছে, ফলে ডাবল মিউটেশন বা অন্য ভেরিয়েন্টও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এটিই ভারতে ২০ ভাগ এবং যুক্তরাজ্যে ৫৯ ভাগ ছড়িয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, কোন রোগীর নমুনায় এই ভেরিয়েন্ট এসেছে; তা যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা এই রোগীদের আলাদাভাবে আইসোলেশনে রেখেছে। তবে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক ডা. দিলীপ কুমার রায় সাংবাদিকদের জানান, করোনা রোগীর ভারতীয় ভেরিয়েন্টের কোনো তথ্য আইইডিসিআর থেকে তারা পাননি। আইইডিসিআর থেকে তথ্য পাওয়ার পরই তারা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন।

যবিপ্রবি’র গবেষক দলটি ভারত থেকে আসা সবাইকে পরপর দুইবার করোনা নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত আইসোলেশনে রেখে পরীক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে ভারতীয় ধরণে আক্রান্ত রোগীরা যে সকল ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছে, তাদের অতিদ্রুত পরীক্ষা করা আবশ্যিক বলে মনে করে গবেষক দলটি। এছাড়া ভারতীয় ধরণ শনাক্ত হওয়ায় সীমানা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যিক বা অন্য কোনো কারণে চালক ও সহকারীদের কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও পরীক্ষা করার প্রয়োজন।

যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, করোনার ভারতীয় ধরণ শনাক্ত হওয়ার ফলে জরুরি সহায়তা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম সেন্টার ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ভারত ফেরত কোনো ব্যক্তির নমুনা আসার সাথে সাথে আমরা পরীক্ষা করব। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ভিলেন্স জোরালো করা হয়েছে।

ভারতে এই ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে মহারাষ্ট্রে শনাক্ত হয় গত ৫ অক্টোবর। সম্প্রতি এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে মৃত্যু ও শনাক্তের। শনিবারও করোনাভাইরাস মহামারিতে একদিনে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে দেশটিতে। সরকারি হিসাবে ভারতে এদিন মৃত্যু হয়েছে চার হাজার ১৮৭ জনের। একইদিন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে চার লাখ এক হাজারের বেশি মানুষ। ভারতে বর্তমানে মোট সক্রিয় রোগীর পরিমাণ ৩৭ লাখ ২৩ হাজার ৪৪৬ জন। মোট মৃতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৩৮ হাজারের বেশি।

ভারতের নতুন ধরনের করোনা ভ্যারিয়েন্ট কোনোভাবেই যাতে বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে সেজন্য সীমান্ত প্রথমে ১৪ দিন পরে আজ শনিবার (৮ মে) আরও ১৪ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ। গত ২৬ এপ্রিল থেকে এই নির্দেশ কার্যকর হয়েছে।

তবে যেসব বাংলাদেশির ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা ভারতে বাংলাদেশি দূতাবাসের বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরছেন। বন্ধ ঘোষণার পর এ পর্যন্ত বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ৪শ’র মতো বাংলাদেশের নাগরিক দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে এক হাজারের মতো যশোরের বিভিন্ন হাসপাতালে কোয়ারেন্টিনে আছেন। আর বাকিদের বিভিন্ন জেলার কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন যশোরের জেলা প্রশাসক।

Pin It