শীত চলে গেছে। তারপরও বেশিরভাগ সময় শীত অনুভূত হওয়ার নানান কারণ থাকতে পারে।
এরমধ্যে জ্বর আসা, ঠাণ্ডা লাগা, ক্লান্তিভাব ইত্যাদি স্বাভাবিক লক্ষণ। তবে এসব কারণ ছাড়াও শীত অনুভূত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের মেডিসিন-বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক পল অ’রোর্ক বলেন, “ঠাণ্ডা অনুভব করা একটি সাধারণ উদ্বেগের বিষয়। তার মানে এই নয় যে আপনি সবসময় অসুস্থ। তবে এমনটা ঘন ঘন দেখা দিল ও এর লক্ষণগুলো চোখে পড়লে সচেতন হতে হবে।”
প্রিভেনশন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “শীত লাগলে কেবল গরম কাপড় না পরে বরং এর কারণ ও উপসর্গ খেয়াল করে তার পরিক্ষা করে নিতে হবে। আর ডাক্তার রোগের ইতিহাস ও লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে যে পরামর্শ দেবেন তা মেনে চলতে হবে।”
অ্যানিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা
পর্যাপ্ত লোহিত কণিকার অভাবে রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়। এটা ফুসফুস থেকে শরীরের বাকি অংশে অক্সিজেন বহন করে নিয়ে যায়। ঠাণ্ডা লাগার ফলে শরীর ক্লান্ত ও দুর্বল অনুভূত হয়, এছাড়াও হালকা মাথা ঘুরানোর মতো অনুভূতি হতে পারে।
রক্ত স্বল্পতা নানান কারণে হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল আয়রন বা লৌহের ঘাটতি।
অ’রোর্ক বলেন, “নারীদের অতিরিক্ত ও ঘন ঘন রক্তস্রাবের কারণ রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও নানান ধরনের রোগ যেমন- আলসারের কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তকণিকা পরিমাপ করে তা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত লৌহের সম্পূরক ধরনের খাবার যেমন- মাংস, ডিম, শাক-সবজি ইত্যাদি খাওয়া উপকারী।”
হাইপোথাইরয়েডিজম
থাইরয়েড হল গলার মাঝামাঝি একটা ছোট গ্রন্থি যা হরমোন তৈরি করে শরীরের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। এই হরমোনের স্বল্পতা এবং ধীর বিপাকের ফলে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়।
এছাড়া অন্যান্য লক্ষণ যেমন শুষ্ক ত্বক, চুল পাতলা হয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, দীর্ঘস্থায়ী ও ঘন ঘন পিরিয়ড এবং অকারণে ওজন বৃদ্ধি ইত্যাদি দেখা দেয়।
অ’রোর্ক বলেন, “রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনের পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া যায়। যদি এর মাত্রা কম হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”
পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ
বা পিএডি হল একটি রক্তনালীর অবস্থা যা ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সিদের প্রভাবিত করে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাত বা পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, ব্যথা বা ঝিঁঝিঁ ধরা ও চুল পড়ে যেতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শে রক্তনালীর প্রবাহ পরীক্ষা করে এবং প্রয়োজনে ধূমপান কমিয়ে কোলেস্টেরল, রক্তচাপ ও ওজন কমানোর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
রেনোড’স রোগ
এটা এমন একটা অবস্থা যখন হাতের ও পায়ের আঙ্গুলে রক্ত চলাচল কমে যায়।
নিউ জার্সি’র ‘রটগার্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ নার্সিং’য়ের ক্লিনিকাল সহযোগী অধ্যাপক অ্যালিন হোম্স বলেন, “এটি একটি শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া। পেরিফেরাল রক্তনালী ঠাণ্ডার কারণে সংকুচিত হয়।”
রক্ত নালীর এই অবস্থা মানসিক চাপের কারণেও ঘটতে পারে। ফলে হাত ও পায়ের আঙ্গুল সাদা বা নীল হয়ে যায়।
রক্তনালীর কার্যকারিতার জন্য পরীক্ষা করে নিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কম ওজন
অতিরিক্ত কম ওজন দেহের প্রয়োজনীয় চর্বির ঘাটতি নির্দেশ করে। সেক্ষেত্রে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে বলে জানান, ও’রার্ক।
পর্যাপ্ত পুষ্টির ঘাটতি দেহের বিপাক হ্রাস করে। ফলে পর্যাপ্ত তাপ উৎপাদন হয় না।
ওজন কম হওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অনিয়মিত মাসিক চক্র, ক্লান্তি বোধ, মাথা ঘোরা, বা বিএমআই ১৮’র কম থাকা।
দেহের ওজন ঠিক রাখতে প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে। এতে শরীর সুস্থ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ওষুধ
ওষুধ গ্রহণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণেও ঠাণ্ডা অনুভূত হতে পারে বলে জানান ও’রার্ক।
সাধারণত, উচ্চ রক্তচাপ, ধীর হৃদগতি ইত্যাদির জন্য খাওয়া ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাত-পা ঠাণ্ডা হওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সম্প্রতি কোনো নতুন ওষুধ খাওয়ার পরে এমন সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসককে জানানো উচিত এবং সামঞ্জস্য বজায় রাখতে যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
পানির স্বল্পতা
হোম্ব বলেন, “পানি পান বিপাক বাড়ায়। ফলে দেহ উষ্ণ থাকে। পানি স্বল্পতার কারণে মুখ শুকিয়া আসা, বাথরুমে কম যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। সারাদিন মাস্ক পরে থাকলে কম পানি পানের প্রবণতা থাকে। তাই দেহের পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে বেশি করে পানি পান করা প্রয়োজন।”
গরম বা শীতকাল দুই সময়েই পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। এতে দেহ আর্দ্র ও সুস্থ থাকবে।
ঘুমের অভাব
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সারাক্ষণ ঠাণ্ডা লাগতে পারে।
অ’রোর্ক বলেন, “ঘুমের অভাব হাইপোথ্যালামাস’য়ের কার্যকলাপকে হ্রাস করতে পারে, যা বিপাক এবং শরীরের তাপমাত্রা-সহ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে।”
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রাতে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। ভালো ঘুম চক্রের জন্য প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার নিয়ম করতে হবে।
ঘুমের আগে ৩০ মিনিট হাঁটা, ‘ডিভাইস’ থেকে দূরে থাকা ও সঠিক তাপমাত্রা নিশ্চিত করে নিতে হবে।
উদ্বেগ
সাধারণ না হলেও অনেকেই উদ্বিগ্ন অবস্থায় ঠাণ্ডা অনুভব করেন। অনেকের হৃদগতির বৃদ্ধি, ঘাম হওয়া, বমিভাব ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
‘প্যানিক অ্যাটাক’ বা উদ্বেগের কারণে হওয়া শারীরিক সমস্যা ও লক্ষণগুলো কাজ করার ক্ষমতাকে ব্যহত করে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।