যে গ্রামে শতভাগ বাল্যবিবাহ

image-208319-1608559199

১৬ বছরের তরুণী তামান্না। ৩ বছর আগে তার বিয়ে হয়। মাহমুদা নামে তার দুই বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। তামান্না বলেন, সে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। এরপর তাকে তার বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেয়। এখন স্বামীর সংসার করেন। অর্থাৎ ১৩ বছর বয়সে তামান্নাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে রাজশাহীর পদ্মার বিচ্ছিন্ন চর খানপুরে থাকেন। পরিবারের অভাব-অনটন এবং স্থানীয়ভাবে উচ্চ শিক্ষার রেওয়াজ না থাকায় মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করতে পারেননি। তবুও তামান্নার এই ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা পরিবার ও স্থানীয়দের কাছে অনেক অর্জন।

তামান্নার মতো তার ১৫ জন বান্ধবীরও ১৩-১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে। মাত্র একজন বান্ধবীর বিয়ে হয়নি। তার নাম আসমা আক্তার বিথী (২০)। বিথীর পরিবার একটু সচেতন হওয়ায় মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে ‘বাল্যবিবাহ’ খাতায় নাম লেখায়নি। কিন্তু সেই সচেতনতাই কাল হলো বিথী ও তার পরিবারের জন্য। বিথীর পরিবার জানায়, গত দুই বছর ধরে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন তারা। কিন্তু বিথীর বয়স ২০ বছর শুনলেই আর কেউ বিয়ে করতে রাজি হয় না। বলে এর বিয়ের বয়স শেষ! এমন একাধিক প্রস্তাব এসে ফিরে যাওয়ায় বিথী একপ্রকারে একঘরে হয়ে পড়েছেন। ঘর থেকেও তেমন একটা বের হন না। সারাক্ষণ মন খারাপ করে চুপচাপ বসে থাকেন।

শুধু বিথীর পরিবারই নয়; তার মতো চরখিদিরপুরে বেশ কয়েকটি পরিবার মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তায় আছেন। মেয়ের বয়স ১৮ কিংবা এর বেশি হওয়ায় কেউ বিয়ে করতে চাচ্ছে না। কীভাবে এর প্রতিকার মিলবে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান না তারা।

রাজশাহী শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর সীমান্তবর্তী গ্রাম খানপুর। গ্রামটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কাতলামারি গ্রাম লাগোয়া। ইতিমধ্যে নদী ভাঙনে খিদিরপুর গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মা নদীর প্রায় ৫শ মিটার এলাকা ভারতীয় কাতলামারি গ্রাম দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। খানপুর গ্রামটিও পদ্মার ভাঙনে বিলীনের পথে। জায়গাটি অনেকে চর খানপুর নামে চিনলেও কাগজে-কলমে এর নাম ‘চরখিদিরপুর পশ্চিম পাড়া’। এটি ৮ নং হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে।

খানপুর গ্রামের আরেক তরুণী তানজিলার (ছদ্মনাম) বয়সও ২০ কিংবা ২১। রূপ-লাবণ্যে আর সৌন্দর্য ছলছল করছে চেহারায়। কোনো দিক দিয়ে কমতি নেই। সমস্যা শুধু বয়সের! তানজিলার পরিবারেরও একই কথা। একে তো থাকেন চরে। তার ওপর আবার মেয়ের বয়স বেশি। এত সমস্যা নিয়ে কে বিয়ে করবে তারে?

মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ১৮ বছর বয়স চরখিদিরপুরের মানুষের কাছে অনেক বেশি। তাদের কাছে ১৩-১৪ বছর বয়স হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের বয়স! ছেলেদের ক্ষেত্রেও মানা হচ্ছে না ২১ বছর বয়স। বাল্যবিবাহের খারাপ দিক নিয়ে বুঝানোর মতো সরকারি-বেসরকারি কেউ নেই ওই চরে। তাই বাল্যবিবাহে আটকে যাচ্ছে তরুণীদের জীবন। প্রায় দুই হাজার মানুষের বসবাস চরটির প্রায় প্রতি ঘরেই রয়েছে বাল্যবিবাহ রীতি।

দুই সন্তানের জননী জোলেখা। জোলেখার মতে, তার বয়স ২৫। তার বড় মেয়ে আমেনা ১২, ছোট মেয়ে উম্মে সালমার বয়স ৬ বছর। সেই হিসেবে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় জুলেখার। তিনি বলেন, ৪র্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে হয়ে যায়। বড় মেয়ে আমেনা ৫ম শ্রেণিতে পড়ছে। বছর খানেক পর মেয়েকে বিয়ে দিবেন, তাই ছেলে দেখছেন!

মোসা. আদরী বেগম তার বয়স ২৮ বছর বলে দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবে তার বয়স আরও অনেক কম। তারও রয়েছে দুই সন্তান। বড় মেয়ে সাদিয়ার বয়স ১২ বছর। আদরী বেগমের হিসেবেও তার বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছর বয়সে অর্থাৎ তারও বাল্যবিবাহ হয়েছিল।

চর খানপুরে একদিকে বাল্যবিবাহ যেমন লাগামহীন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে নেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা। ফলে ওই চরের জনসংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। অথচ এখনও সকল মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না চরের বাসিন্দারা।

স্থানীয় চর তারানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোসা. শামসুর নাহার বলেন, তারা শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক লেভেলে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ অত্যন্ত গরীব। তাই অনেক পরিবার অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। প্রতি বছর ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়। কিন্তু ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে।

চরের বয়োবৃদ্ধ রজত আলী জানান, আগে এখানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি অফিস ছিল। বেশ কয়েক বছর আগে সেটি নদীতে ভেঙে যায়। এখন ২/১টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই। পরিবার পরিকল্পনা ও এনজিওর লোকজন মাঝে মধ্যে আসেন। সকালে ট্রলারযোগে এসে কিছু সময় কথা বলে আবার বিকালের ট্রলারে চলে যান। একটি বাড়িতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ রেখে যান। কারও লাগলে সেখান থেকে নিয়ে আসেন। তবে চক্ষুলজ্জায় মেয়েরা এসব ওষুধ নিতেই আসে না।

৮ নং হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনোভাবেই বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না। পরিবার রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। বাল্যবিবাহ রোধে তিনি বাদী হয়ে একটি মামলাও করেছেন। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি।

Pin It