ইতিহাসসচেতন ব্যক্তিরা জানেন, সব যুগের মানুষেরই তার সময়ের প্রতি অভিযোগ ছিল। তবে সব যুগেই এমন মানুষ ছিলেন, যাঁরা মানবতার মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন এবং নিজের কীর্তি দ্বারা প্রমাণ করেছেন—যাদের কিছু করার সৎ সাহস নেই, শুধু তারাই সময়ের প্রতি অভিযোগ করে। এখনো একদল মানুষ বলে বেড়ান সময় ভালো না, সীমাহীন খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে সময় এবং পৃথিবীতে কোনো কীর্তিমান ব্যক্তি নেই। মহানবী (সা.)-এর বাণী—‘সর্বোত্তম সময় হলো আমার সময়। এরপর যারা তাদের সঙ্গে মিলিত হবে এবং তারপর উত্তম যারা তাদের সঙ্গে মিলিত হবে’ দ্বারা প্রমাণ করতে চায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর মন্দ সময় শুরু হয়েছে। কিন্তু মহানবী (সা.) তো এই সুসংবাদও দিয়েছেন যে প্রত্যেক যুগে একজন সংস্কারক আসবেন, যিনি ইসলাম ধর্মকে অধঃপতন ও মন্দ প্রভাব থেকে রক্ষা করবেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রত্যেক শতাব্দীতে এমন মহান ব্যক্তিদের আগমন হয়েছে, যাঁরা মহানবী (সা.)-এর মহান শিক্ষাকে বিকৃতি ও বিলোপের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। যাঁরা নিজের নিষ্ঠা, প্রচেষ্টা, অদম্য স্পৃহা ও সৎ সাহসের মাধ্যমে দ্বিনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, মানুষ ও মানবতার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামের মহান চার খলিফার পরবর্তী সময়ে মুসলিম জাহানের আকাশে এমন বহু উজ্জ্বল নক্ষত্রের আগমন হয়েছে, যাঁরা উম্মতের পথপ্রদর্শন, ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুনর্জাগরণ এবং মানবজাতিকে মনুষ্যত্ব শিখিয়েছেন। তাঁরা নম্রের সঙ্গে বিনম্র এবং অভদ্রের সঙ্গে কঠোর আচরণ করেছেন, দূরদৃষ্টি ও হৃদয়ের মমত্ব দিয়ে যুগের দুর্যোগ মোকাবেলা করেছেন, ইসলামের প্রদীপ প্রজ্বলিত রেখেছেন।
গত শতকের শেষভাগে এমন দিকপাল আলেমদের মধ্যে আছেন—শায়খ আলী তানতাভি, শায়খ মোস্তফা জারকা, শায়খ আবদুল্লাহ বিন বাজ, শায়খ মান্না আল-কাত্তান, শায়খ ওমর ফাল্লাতা, শায়খ মুহাম্মদ মাজঝুব, মুফতি আবদুর রশিদ নোমানি, মাওলানা মুঈনুল্লাহ, মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি, মাওলানা সাঈদ আহমদ খান, আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) প্রমুখ। এই মহান পুরুষরা চলে গেছেন। তবে তাঁদের হারিয়ে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটাও ঠিক, তাঁরা আমাদের সামনে বাতিঘরতুল্য চেষ্টা, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও কীর্তি রেখে গেছেন। আমরা বলি, তাঁদের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু তাঁদের কর্মপন্থা আমাদের বলে; বরং তাঁদের আত্মাগুলো আমাদের বলছে, আমরা যা করেছিলাম তাতে সময়ের কোনো অনুগ্রহ ছিল না এবং তা আমরা নিজ সামর্থ্যেও করিনি; বরং আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিয়েছেন, তাঁর দ্বিন আমাদের সহায়ক ছিল। আমরা গত হয়েছি, কিন্তু আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের দরজা বন্ধ হয়নি এবং পৃথিবীতে তাঁর দ্বিনও বহাল আছে। সুতরাং হতাশা ও হীনম্মন্যতার শিকার না হয়ে নিজেদের সাহস বৃদ্ধি করো; নিষ্ঠা, প্রত্যয় ও উচ্চাশা সৃষ্টি করো। আল্লাহর কাছে সুযোগ চাও এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাও। তিনি তোমাদের ভেতর এমন রত্ন সৃষ্টি করবেন, যা হারানোর আক্ষেপ তোমাদের আচ্ছন্ন করে আছে। শুধু প্রয়োজন সেই কর্মবীর পুরুষের, যিনি নিজের যোগ্যতাগুলো নেতৃত্বের উপযোগী করতে নিষ্ঠা, অগ্রাধিকার ও আত্মত্যাগের প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসবেন এবং ব্যথিত হৃদয় ও অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে উম্মতের দ্বারে দ্বারে যাবেন। ১৪০০ বছর ধরে ইসলাম যেভাবে মনুষ্যত্ব ও মানবতার বীজতলা হিসেবে পৃথিবীকে সজীব রেখেছে, এখনো তেমনটিই হবে। সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়েই জাতি জাগবে এবং ডুবন্তপ্রায় তাদের জাহাজ গতিশীল হবে।
অনেকেই মুসলিম জাতির শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে সংশয় পোষণ করে। মুসলিম উম্মাহের শক্তি ও সামর্থ্যের কোনো অভাব নেই। তবে তাদের শক্তিমত্তার ওপর কালের দুর্যোগ ধুলো-বালির আস্তর ফেলেছে। এই আস্তর সরাতে প্রয়োজন আত্মপূজা, স্বেচ্ছাচারী জীবন ও জাগতিক মোহ ত্যাগ করা। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সংগ্রাম ও সাধনা জাতির মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার করবে এবং আমরা যেসব মনীষীর শূন্যতা অনুভব করি, তা পূরণ হবে। প্রকৃতার্থে বর্তমানে আলেম, চিন্তাবিদ ও লেখক-সাহিত্যিকের অভাব নেই। অভাব শুধু হৃদয়বান অভিভাবকের, অভাব সাইয়েদ আহমদ শহিদ (রহ.)-এর মতো ব্যথিতপ্রাণ নেতৃত্বের। যে ব্যথার ধারক ছিলেন মাওলানা কাসেম নানুতবি ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুঙ্গেরি (রহ.)-এর মতো আমাদের মহান অভিভাবকরা।
প্রশ্ন হতে পারে, সময়ের নেতৃত্ব দানকারী আলেম সৃষ্টি এবং নিজের অবদানের মাধ্যমে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করা আল্লাহর বিধান ও রীতির অন্তর্ভুক্ত। তা হলে আমাদের করণীয় কী? এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূরণ করেছে, তাদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় আছে। তারা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২৩)
আমরা যারা পিছিয়ে আছি তারা আয়াতে বিবৃত ‘প্রতীক্ষায় আছে’ বাক্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন প্রয়োজন সময়ের দাবি অনুযায়ী আমাদের কোন কোন অঙ্গীকার পূরণ করার আছে তা খুঁজে বের করা। অতীতে সময়ের নেতৃত্ব দানকারী আলেমদের জীবনচরিত দেখলে বোঝা যায়, সময়ের প্রলয়ঙ্করী ঝড় দেখে ভয় পাওয়া যাবে না; বরং সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আর বেশি প্রয়োজন তাদের বোধ ও ব্যথা, চিন্তা ও চেতনা ধারণ করা—যতটা না প্রয়োজন বাহ্যিক প্রস্তুতির। বাহ্যিক সাজসজ্জার অভাব নেই, অভাব ব্যথাভরা হৃদয়ের আর অস্থিরতার।
ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু সংকটময় সময় এসেছে, যখন বাহ্যত মনে হয়েছে পৃথিবী থেকে ইসলামের প্রদীপ বুঝি নিভে যাবে। কিন্তু আল্লাহ সেই সংকটময় সময়েও ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা করেছেন। বাহ্যিক সব উপায়-উপকরণ হারানোর পরও আল্লাহ তাঁর কোনো একজন বান্দাকে সময়ের নেতৃত্বের জন্য পাঠিয়েছেন এবং তাঁরা সেই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে অসীম সাহস, ধৈর্য ও আল্লাহ-নির্ভরতার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর মনে আশার আলো সঞ্চার করেছেন এবং সময়ের সব ঝড়ের বিপরীতে ইসলামের পতাকা সমুচ্চ করেছেন। আমরা যদি তাঁদের সেই নিষ্ঠা, সাহস ও আল্লাহনির্ভরতা ধারণ করতে পারি, তাহলে কোনো কারণ নেই আল্লাহ আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন এবং আমাদের সেই সুমহান কাফেলার সহযাত্রী করবেন না।
তামিরে হায়াত থেকে আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর