রপ্তানি আয় কমছেই। টানা চার মাস ধরে কমছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক।
আর এতে আতংকিত হয়ে পড়েছেন রপ্তানিকারকরা। রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা জরুরিভিত্তিতে সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছেন।
তানাহলে আগামী দিনগুলোতেও ‘এই নেতিবাচক’ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশংকা করছেন তারা।
চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ (১৫.৭৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। এই মাসে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১৮ শতাংশ।
নভেম্বরে ৩০৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত বছরের নভেম্বরে আয় হয়েছিল ৩৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার।
সার্বিক পরিস্থিতিকে ‘খুবই খারাপ’ উল্লেখ করে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, নতুন করে কিছু বলার নেই। দিন যতো যাচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খারাপ হচ্ছে।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমাতে বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
সুখবর নিয়ে অর্থবছর শুরু হলেও দ্বিতীয় মাস অগাস্টে এসেই ধাক্কা খায় রপ্তানি আয়। প্রথম মাস জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল।
কিন্তু অগাস্ট মাসে গত বছরের অগাস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কম আসে। সেপ্টেম্বরে কমে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। অক্টোবরে আরও বড় ধাক্কা খায়: এ মাসে কমে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ।
সবমিলিয়ে টানা চার মাস ধরে কমছে রপ্তানি আয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
গত বছরের একই সময়ে রপ্তানির অংক ছিল এক হাজার ৭০৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।
এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল এক হাজার ৮০৫ কোটি ডলার।
এ হিসাবেই চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
পোশাক রপ্তানি কমেছে ৮ শতাংশ
জুলাই-নভেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৩০৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম।
এই পাঁচ মাসে নিট পোশাক রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আর উভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
এই পাঁচ মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৬৮১ কোটি ডলার। আর উভেন থেকে এসেছে ৭২৮ কোটি ডলার।
পাঁচ মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, “সত্যিই খুবই খারাপ অবস্থা। আমাদের সব অর্ডার ভিয়েতনাম-ভারতে চলে যাচ্ছে। সরকারের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া এই খারাপ অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারব না।”
“খুব চিন্তার মধ্যে আছি আমরা। ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ৬০টি কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে।”
“এই মুহূর্তে আমাদের পলিসি সাপোর্ট দরকার। এবং সেটা দ্রুত দরকার। আমরা রপ্তানি খাতের জন্য টাকা-ডলারের আলাদা বিনিময় রেট চাই। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সেটা ঠিক করে দিতে হবে। একইসঙ্গে আমরা নগদ সহায়তা ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।”
“এবং খুব দ্রুত এসব করতে হবে। মনে রাখতে হবে। খুব কঠিন সময় পার করছি আমরা; আমাদের অর্থনীতি। আরও খারাপ অবস্থা যেনো না হয় সেজন্যই সব সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে।”
তথ্য দিয়ে রুবানা হক বলেন, ভারত সরকার তাদের দেশের পণ্য রপ্তানির উপর ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এজন্য তারা ৫০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। পাকিস্তান ৭ শতাংশ সহায়তা দিচ্ছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এই মুহুর্তে যেটা করতে হবে সেটা হল ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মান কমাতে হবে। যে কাজটি আমাদের কমপিটিটর দেশ চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম প্রতিনিয়ত করছে। আমাদেরও এখন সেই কাজটি করতে হবে।”
তিনি বলেন, মূলত: দুটি কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে। প্রথমত: ইউরোপের দেশগুলো আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার। সেখানে এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সে কারণে সে দেশগুলোর মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছে। পোশাকসহ অন্যান্য জিনিস কম কিনছে। তবে আমেরিকার অর্থনীতি চাঙ্গার কারণে সেখানকার বাজারে বাংলাদেশ ভালো করছে।
দ্বিতীয় কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “আমাদের নিজস্ব সমস্যা আছে। সেটা হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ায়নি বায়াররা। প্রতিযোগী দেশগুলো বাজার ধরে রাখতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে; আমরা সেটাও করিনি। সবমিলিয়েই আমরা পিছিয়ে পড়ছি।”
আমেরিকা-চীনের বাণিজ্য যদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে জানিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “আমেরিকার বাজারে আমাদের রপ্তানি বাড়লেও অন্য দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ছি। এতোদিন ইউএস মার্কেটে আমরা ৩/৪ নম্বরে ছিলাম। এখন ৭ নম্বরে নেমে এসছি।”
সবমিলিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চীন, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো আমাদের টাকার অবম্যূল্যায়নের পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রপ্তানি আয় বাড়াতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো ছাড়া এই মুহুর্তে বাংলাদেশের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ নেই। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে টাকার মান কিছুটা কমিয়েছে। কিন্তু সেটা খুবই নগণ্য।
বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনে (ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা) প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। এক মাসে আগে ৩১ অক্টোবর আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৭০ পয়সা। পাঁচ মাস আগে ৩০ জুন ছিল ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা।
ডলারের দাম আরও বাড়ানোর পক্ষপাতি আহসান মনসুর বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ৮ থেকে ১০ শতাংশ বাড়াতে হবে।
“চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধা দিতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। ডলার শক্তিশালী করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। অর্থনীতির স্বার্থেই এটা করতে হবে।”
দীর্ঘদিন ডলার-টাকার বিনিময় হার ধরে রাখা ঠিক হয়নি মন্তব্য করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “অনেক পিছিয়ে গেছি আমরা। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো বিশ্ববাজার দখল করতে তাদের মুদ্রার মান অনেক কমিয়েছে; আমরা করিনি।”
‘এখন টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়াতে ‘বড় ধরনের অ্যাকশনে’ যাওয়ার পক্ষপাতি তিনি। তার হিসাবে, ডলারের দর এখন ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৯১ টাকা ৮০ পয়সা হওয়া উচিৎ।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর মনে করেন, ডলারের দাম বাড়ালে রপ্তানি আয়ে বিপর্যয় যেমন কেটে যাবে, তেমনি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সও বাড়বে।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে জুলাই-নভেম্বর সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। চা রপ্তানি বেড়েছে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।
তবে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ১০ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৩ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশ।
এই পাঁচ মাসে শাক-সবজি রপ্তানি বেড়েছে ১৫১ শতাংশ। হ্যান্ডিক্যাফট রপ্তানি বেড়েছে ৫ শতাংশ। তবে তামাক রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশ।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।