এক সময়ে একই দূরত্বে কোম্পানি ভেদে প্রাইভেটকারের ভাড়া দেখায় ভিন্ন, আবার চাহিদার কথা বলে নেওয়া হয় বাড়তি ভাড়া, মোটরসাইকেল রাইডে একেক কোম্পানির একেক চার্জ- রাইড শেয়ারিং সেবায় ভাড়ার এই রকমফেরে অসন্তোষ জানিয়েছেন যাত্রীরা।
ভাড়া নিয়ে বিরক্ত খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা মানিক মুনতাসির বলছেন, “রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায় শুধু সহজে গাড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া আমি আর কোনো সুবিধা দেখি না।”
গণপরিবহনের সংকটের শহরে গাড়িতে উঠতে গলদঘর্ম হওয়া ঢাকাবাসীর সামনে রাইড শেয়ারিং সেবা আসার পরপরই তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপরে এই খাতকে নিয়ম-নীতির মধ্যে আনতে গেল বছর ‘রাইড শেয়ারিং’ নীতিমালা করে সরকার।
মোটরসাইকেলের ভাড়া কী হবে, সে বিষয়ে কিছুই বলা নেই নীতিমালায়। এই সুযোগে রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা ইচ্ছেমতো ভাড়া ঠিক করে।
এদিকে প্রাইভেটকারের ভাড়ার ক্ষেত্রে সাধারণ গাড়িতে চড়লেও বিলাসবহুল কারের ভাড়া দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
ট্যাক্সিক্যাব নীতিমালা অনুযায়ী, প্রথম দুই কিলোমিটার ৮৫ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ৩৪ টাকা এবং প্রতি দুই মিনিটের জন্য আট টাকা ৫০ পয়সা ভাড়া হবে। ইকোনমি ট্যাক্সিক্যাবে প্রথম দুই কিলোমিটার ৫০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা করে।
প্রতি দুই মিনিট ওয়েটিং টাইমের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা এবং ইকোনমি ক্যাবের জন্য ৩ টাকা করে নেওয়ার বিধান আছে।
সিএনজিচালিত অটোরিকশার প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা এবং প্রতি দুই মিনিটের ওয়েটিং চার্জ ২ টাকা ধরা হয়।
ট্যাক্সিক্যাব বা অটোরিকশায় ওয়েটিং চার্জ প্রতি দুই মিনিটের জন্য ধরা হলেও রাইড শেয়ারিংয়ে যাত্রা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি মিনিটের জন্য আলাদা টাকা দিতে হয়। অর্থাৎ একটি ট্রিপ শেষ করতে যদি ৩০ মিনিট সময় লাগে তাহলে ৩০ মিনিটের জন্যই আলাদা টাকা ভাড়ার সঙ্গে যোগ হবে।
রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাড়ার হারেও রয়েছে তারতম্য। মোটরসাইকেল রাইডে উবারমটোর প্রারম্ভিক ভাড়া ৩০ টাকা, পরে প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং প্রতি মিনিট ওয়েটিং চার্জ এক টাকা। আবার পাঠাওয়ে প্রারম্ভিক ভাড়া ২৫ টাকা, পরবর্তী কিলোমিটার ১২ টাকা, প্রতি মিনিট ওয়েটিং চার্জ ৫০ পয়সা। পিকমির প্রারম্ভিক ভাড়া ২৪ টাকা, পরবর্তী কিলোমিটার ১২ টাকা, প্রতি মিনিট ৫০ পয়সা এবং এগুলোর সঙ্গে রিকোয়েস্ট চার্জ ২৫ টাকা।
আবার ওভাইয়ের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০০ টাকা। ওভাই প্রথম ছয় কিলোমিটার হিসাব করে এ টাকা ধার্য করে। অর্থাৎ এক কিলোমিটার গেলেও তাদেরকে ১০০ টাকাই দিতে হবে। এই সেবায় পরবর্তী কিলোমিটার ২০ টাকা, তবে কোনো ‘ওয়েটিং চার্জ’ নাই।
প্রাইভেটকারে উবার প্রিমিয়ারে প্রারম্ভিক ভাড়া ৮০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২২ টাকা, প্রতি মিনিট ৩ টাকা; উবারএক্সে প্রারম্ভিক ভাড়া ৪০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ১৮ টাকা এবং প্রতি মিনিট ৩ টাকা।
কিন্তু পাঠাও কার রাইডে প্রারম্ভিক ভাড়া ৫০ টাকা, প্রতি কিলোমিটার ২০ টাকা এবং প্রতি মিনিটের জন্য আড়াই টাকা করে নেওয়া হয়।
পিকমিতে আবার অন্য হিসাব। এই রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কারে প্রথম দুই কিলোমিটার ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ২০ টাকা। প্রতি ২ মিনিট ওয়েটিং টাইমের জন্য ভাড়া ৬ টাকা। এতে ইউজার রিকোয়েস্ট চার্জ হিসেবে ৫০ টাকা দিতে হবে।
রাজধানীর কয়েকটি গন্তব্যে যেতে একই সময়ে চারটি রাইড শেয়ারিং সেবার অ্যাপে অনুরোধ পাঠিয়ে দেখা গেছে, একই গন্তব্যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভাড়া একেক রকম।
জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে মোটরসাইকেলে সহজ রাইডসে ১৭২ টাকা, পাঠাওয়ে ১৭৭, উবারমটোতে ১৮০, ওভাইয়ে ২০৫ এবং পিকমিতে ১৭৫ টাকা সম্ভাব্য ভাড়া আসে। এই দূরত্বে প্রাইভেটকারের ভাড়া পাঠাওয়ে কারপ্লাসে ৩৯৭, উবারএক্সে ৩৫৯, উবার প্রিমিয়ারে ৪৫০ এবং সহজ কারে ৩৬০ টাকা সম্ভাব্য ভাড়া দেখায়।
আনুমানিক ভাড়ার চেয়ে প্রকৃত ভাড়া অনেক সময় অস্বাভাবিক বেশি দেখায় বলে অভিযোগ করেন আইসিডিডিআর’বির কর্মকর্তা আকলিমা চৌধুরী।
তিনি বলেন, “মহাখালী থেকে মিরপুর-১ নম্বর পর্যন্ত উবারে এস্টিমেটেড ভাড়া দেখিয়েছে ৫৩৬ টাকা। কিন্তু গন্তব্যে আসতে আসতে ভাড়া হয়ে গেছে ৮২৫ টাকা। আমি সেটা পরিশোধ করেছি, ছবিও তুলে রেখেছি। কিন্তু পরে ট্রিপ হিস্ট্রিতে গিয়ে দেখি তা চেঞ্জ হয়ে ৫৩৬ টাকা হয়ে গেছে।”
দিনের ব্যস্ত সময়গুলোতে গাড়ির চাহিদা বাড়লে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয় জানিয়ে সেবাগ্রহীতা মানিক মুনতাসির বলেন, “এখন রাইড শেয়ারিংয়ে সিএনজি অটোরিকশার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। একই দূরত্ব অথচ ভাড়া একেক সময় একেক রকম। একটু ডিমান্ড বাড়লেই ভাড়া বাড়িয়ে দেয়।
“ইদানিং ভাড়া আরও বেড়েছে। আগে ডিসকাউন্ট ছাড়াই খিলগাঁও থেকে সাড়ে তিনশ থেকে চারশ টাকায় উত্তরা যেতাম। কিন্তু এখন ডিসকাউন্ট দেওয়ার পরও পাঁচশ টাকার কমে যেতে পারছি না।”
চাহিদা বেশি থাকলে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া অন্যায় বলে মন্তব্য করেন মিরপুরের কালসী রোডের বাসিন্দা রাজিবুর রহমান।
ধানমণ্ডির বাসিন্দা নেয়ামত উল্লাহর অভিযোগ, ট্রিপে আনুমানিক ভাড়ার চেয়ে বেশি হলে তার বিস্তারিত ভাউচারে দেখায়, কিন্তু কম হলে দেখায় না।
“যখন সম্ভাব্য ভাড়ার মধ্যেই ট্রিপ শেষ হয় তখন আমাকে বিস্তারিত হিসাব দেয় না। কিন্তু যখন এস্টিমেটেড টাকার লিমিট ক্রস করে যায় তখন তারা যে মেইল পাঠায় সেখানে বলা থাকে বেইজ ফেয়ার, দূরত্ব, সময়, টোটাল টাকার পরিমাণ। এখানে বোনাস থাকলে সেটাও বাদ দেয়।
“কিন্তু যদি আনুমানিক ভাড়া ৪০০ টাকা দেখায়, আর ওই ৪০০ টাকার মধ্যে ট্রিপ শেষ হলে শুধু মোট বিলের পরিমাণটা লেখা থাকে। এই টাকাটা কীভাবে হলো তা দেখায় না। আর ভাড়া এস্টিমেটেড বিলের চেয়ে কম কখনোই হয় না।”
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শুভ্রা পাল বলেন, যাত্রী আকর্ষণের জন্য প্রথম দিকে ‘ডিসকাউন্ট’ দিলেও পরে তা কমিয়ে দেয়।
“গত দুই সপ্তাহ বাইকে ডিসকাউন্ট পাইনি, কারে ডিসকাউন্ট নাই গত দুই মাসের বেশি। আমি নিয়মিত মোহাম্মদপুর-গুলশান যাতায়াত করি। এখানে ডিসকাউন্ট ছাড়া উবারমটো, ওভাইয়ে ভাড়া আসে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। পাঠাওয়ে গেলে ভাড়া আসে ১৯০ থেকে ২০০ টাকার মতো। এখন তো মনে হয় ২০০ টাকা খরচ করে সিএনজি অটোরিকশায় গেলে কমপক্ষে ভালোভাবে আরাম করে বসে যেতে পারতাম।”
রাইড শেয়ারিং সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাড়া নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরীফুল হাসান। তিনি বলেন, ভাড়া বেশি হওয়ায় অটোরিকশায় চড়া শুরু করেছেন।
“উবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম গত দুই বছর। কিন্তু সেবার মান কমে যাওয়া, বাড়তি ভাড়া ও ডিসকাউন্ট কমে যাওয়ার কারণে বিকল্প খুঁজছি। অ্যাপ ব্যবহার করে সিএনজিতে চড়লাম। সাথে সাথে পেয়েছি, ভাড়াও তুলনামূলক কম। অটোরিকশা যদি মিটারে যায় তাহলে খুবই ভালো হয়। আর দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা ঠিক হওয়া খুবই জরুরি।”
“জ্বালানি, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির কথা মাথায় রেখে আমাদের ভাড়া নির্ধারণ হয়ে থাকে। এছাড়া সেবার গুণগত মান ঠিক রাখা এবং যাত্রী নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ রেখে ওভাই প্ল্যাটফর্মের খরচও মোট ভাড়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়।”
উবারের ভাড়া ‘পরিবর্তনশীল ভাড়া আদায় ব্যবস্থায়’ নির্ধারিত হয় বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
“এর মানে যাত্রী যে ভাড়া দেন তা সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। মূলত সম্ভাব্য দূরত্ব, সময়, যানজট এবং ওই সময়ে উবার ব্যবহারের চাহিদার উপর নির্ভর করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। চালক যেন সময়মতো রাইড নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য চাহিদার ও যোগানের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তনশীল ভাড়া (ডাইন্যামিক প্রাইসিং) ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছে। এ ব্যবস্থার কারণে সাময়িকভাবে ভাড়া কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে,” বলেছে তারা।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও পাঠাওয়ের সাড়া পাওয়া যায়নি। সহজ ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা এম কাদিরের মোবাইলে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের অসন্তোষের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআরটিএর পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, এই ভাড়া তারা নির্ধারণ করে দেননি। তবে ভাড়া অবশ্যই ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়ার চেয়ে বেশি হতে পারবে না।
“রাইড শেয়ারিং সেবার ভাড়া কী হবে, তা নিয়ে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। নীতিমালায় বলা আছে, ট্যাক্সিক্যাবের জন্য যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়া এর চেয়ে বেশি হতে পারবে না। এর চেয়ে কম ভাড়া নিতে হবে। তবে কোনো কারণে এর পরিবর্তন প্রয়োজন হলে সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমন্বয় করা যাবে।”