রাজনীতি করি মানুষের জন্য, নিজের জন্য নয়: প্রধানমন্ত্রী

Untitled-1-5c76956929233

দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাজনীতি করি দেশের মানুষের জন্য, নিজের জন্য নয়। কাজেই মানুষের সমস্যা জানার এবং সমাধানের চেষ্টা করি। রাজনীতিবিদ হিসেবে এটাকেই নিজের কর্তব্য বলে মনে করি। আর ক্ষমতা ভোগ করার বিষয় নয়, জনসেবার বিষয়। সেজন্যই বাংলাদেশের মানুষের কীভাবে কল্যাণ করতে পারি, সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।

বুধবার একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

সামাজিক সচেতনতার সৃষ্টির মাধ্যমে মাদকমুক্ত দেশ ও সমাজ গড়ে তোলার ওপর সবাইকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে সংসদ নেতা বলেন, সংসদ সদস্য ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদেরও নিজ নিজ এলাকায় কেউ যাতে মাদকাসক্ত না হয়, মাদকমুক্ত সমাজ যাতে গড়ে তোলা যায়- সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। আর সরকার যাদের আত্মসমর্পন করাচ্ছে তাদের চিকিৎসা ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মাদক থেকে দূরে রাখার পদক্ষেপ নিয়েছে। মাদকব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা আত্মসমর্পণ করছে- তাদের সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা অন্য কোনো ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে ভালভাবে চলতে পারে। এভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এদিন সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের লিখিত ও সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা আরও বলেন, কারণ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, সন্ত্রাস দমন, চাঁদাবাজী রোধ এবং জঙ্গীবাদ দমনে ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে তার সরকার সর্বদা তৎপর। ইতোমধ্যে জঙ্গীবাদ দমনের সফলতা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানে যেখানে মাদক চোলাচালান হয়, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মাদক নিয়ন্ত্রণ ও চোরাচালান বন্ধে সরকার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী মাদক পরিবহণ ও চোরাচালানের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) বিধান রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজধানীর যানজট নিরসনে গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হবে। আমরা যখনই সরকারে আসি, তখনই গণপরিবহণ ব্যবস্থার ওপর জোর দেই। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিআরটিসিসহ গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ বিআরটিসি লাভজনক নয়। আমরা ক্ষমতায় এসে আবার বিআরটিসিকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো বিআরটিসি বাস ক্রয় করি। কিন্তু আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত ৩ থেকে ৪শ’ বিআরটিসির বাস পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা আবারও ক্ষমতায় এসে গণপরিবহণ যত বেশি চালু করতে পারি- সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকা শহরের মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার সবই গণপরিবহণের আওতায় করা হচ্ছে। যানজট নিরসনে বিআরটিসিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগও সরকার নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় দেশেও ট্রাফিক সমস্যা রয়েছে। কারণ জনসংখ্যা বাড়ছে, মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে। ঢাকার যানজট নিরসনে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা ও ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে। এটা চালু হলে যানজট নিরসন আরও কার্যকর হবে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার উদাত্ত আহ্বান জানান। সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম মহানগরে যানজট নিরসনে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, এক্ষেত্রে ভবিষ্যতেও আরও অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।

সরকারি দলের মাহফুজুর রহমানের লিখিত প্রশ্নের জবাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে তার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে যুবসমাজকে মুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার বদ্ধপরিকর। সমাজকে মাদকমুক্ত করতে বাস্তবমুখী পরিকল্পনার আওতায় নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করে মাদকের পরিমাণভেদে সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। মাদক সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো দ্রুত ও যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ও পুলিশের চলমান অভিযান ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার দেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জঙ্গীবাদ নির্মূল সংক্রান্ত বর্তমান সরকারের গৃহীত জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের অপারেশনাল ও লজিস্টিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্পেশালাইজড নতুন ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) গঠন, বাহিনীর সদস্যদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি জানান, পুলিশ এ যাবত বেশকিছু বড় সফল অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গিতৎপরতা প্রতিরোধ করেছে। জঙ্গি সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িতদের সনাক্তকরণের সুবিধার্থে হ্যালো সিটি, রিপোর্ট টু র‌্যাব প্রভৃতি অনলাইন এ্যাপস চালু করা হয়েছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থার পাশাপাশি জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত, সাজাপ্রাপ্ত ও আটক জঙ্গিদের নিবিড় নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে সফলতা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়েছে।

২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভিলক্ষ্য অর্জন, ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্টের জন্য আমরা বহুবিধ কার্যক্রম নিয়েছি।

সরকার দলীয় আরেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজধানীর ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য ইতোপূর্বে রাজধানীর পাশ্ববর্তী এলাকায় চারটি স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের লক্ষে পিপিপি পদ্ধতিতে প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

এগুলো হচ্ছে বংশী-ধামরাই স্যাটেলাইট টাউন উন্নয়ন, ধলেশ্বরী-সিংগাইর স্যাটেলাইট টাউন উন্নয়ন, ইছামতি-সিরাজদিখান স্যাটেলাইট টাউন উন্নয়ন এবং সাভার স্যাটেলাইট টাউনে হাইরাইজ এপার্টমেন্ট প্রকল্প। প্রকল্পগুলো পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্ত্মবায়নের লক্ষে কার্যক্রম চলছে। এছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজধানী ঢাকার পাশ্ববর্তী এলাকায় ৪টি স্যাটেলাইট সিটি বিশেষ করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে রাজউক কর্তৃক ২টি এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঢাকার পশ্চিম ও দক্ষিণে ২টি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী দেশের সব গ্রামকে শহরের সুযোগ সুবিধা দিতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সব গ্রামে শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সবধরনের নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গিকার।

এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার গ্রামকেন্দ্রিক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এক্ষেত্রে তার নেতৃত্বাধীন গত দুই সরকার গৃহীত নানা পদক্ষেপও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

সরকারি দলের সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মহানগরীরে যানজট সমস্যা নিরসনে গত ১০ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মাধ্যমে বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে খুব শিগগিরই ঢাকা মহানগরীকে যানজটমুক্ত করা হবে আশা করা যায়। আগামীদিনের পরিকল্পনার মধ্যে ঢাকা শহরের চতুর্দিকে বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পও রয়েছে।

যানজট নিরসনে আগামীদিনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরী ও পাশ্ববর্তী মহানগরীর সঙ্গে দ্রুতগতির আধুনিক পরিবহনব্যবস্থা হিসেবে কমলাপুর হতে নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-৪ নির্মাণ এবং গাবতলী হতে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-২ নির্মাণ করা হবে।

Pin It