ব্যাংক মালিকরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তারা কথা দিয়েছিলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সুদের হার কমেনি। এ কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মার্চ জাতীয় শিল্পমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, সুদের হার কমালেন না কেন? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব তীব্র রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সার্বিক অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক ভালো না থাকলে অর্থনীতিও ভালো থাকবে না।
ব্যাংক মালিকরা যে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :ব্যাংক ব্যবসার করপোরেট কর কমানো হয়েছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা এবং এক পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ দিয়ে সংশোধন করা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন। এমনকি ৫০ ভাগ পর্যন্ত সরকারি আমানত গ্রহণের সুযোগও দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার কমাননি। বর্তমানে কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু নির্দেশনা আকারে সেটা জারি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের সিআরআর কমানো, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, পরিচালক সংখ্যা বা পরিচালকদের মেয়াদ- সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব ঘটনার ফলে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবসরে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ পাওয়ার আশায় নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে দুর্বল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আবার বড় গ্রুপের ঋণ অনিয়ম বা বেনামি ঋণ ধরতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
বাছ-বিচার না করে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন ব্যাংক দেওয়া নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে আরও তিনটি ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংক না দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দফায় দফায় চিঠি দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত বছর দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে অনুমোদিত নতুন নয়টি ব্যাংক অধিকাংশ শর্ত পালন করতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসার কথা থাকলেও তা পারেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক দেওয়ার বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনা করতে বলা হয়। এর আগে নয়টি ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ব্যাংক দেওয়া হবে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছায়।
সংশ্নিষ্টরা বলেন, অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংক বেশি হয়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে অসম প্রতিযোগিতা বাড়ছে। নতুন ব্যাংক ভালো গ্রাহক না পেয়ে অন্য ব্যাংকের গ্রাহককে ভাগিয়ে আনতে অনৈতিক চর্চা করছে। কোনো কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কিনে নিচ্ছে। আর নামিদামি গ্রুপের পেছনে ছুটছে সব ব্যাংক। এতে কখনও কখনও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন অনেক গ্রাহক। এভাবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। পরে আর এ টাকা ফেরত দিতে আগ্রহ বোধ করছেন না গ্রহীতারা। আরেকটি পক্ষ ভালো উদ্যোগেও ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংক খাতের অসম ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা রোধে দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকগুলো একীভূত করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এর আগে অনুমোদিত নয়টি ব্যাংক আকর্ষণীয় কোনো প্রোডাক্ট আনতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যাংক জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। এখন সময় এসেছে ছোট ব্যাংকগুলো একীভূত করার। তা না করে নতুন করে আবার ব্যাংকের অনুমোদন কেন দেওয়া হয়েছে- বোধগম্য নয়। তিনি মনে করেন, বিদ্যমান ব্যাংকের শাখা বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রচলিত ধারার ব্যাংকিং সেবা বাড়াতে হবে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংককে উপেক্ষা করে ঋণখেলাপিদের জন্য নতুন সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এ সুযোগ পাবেন অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি বা অসাধু ঋণখেলাপি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হলো নির্দেশিত ঋণ, নিম্নমানের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দুর্বল করপোরেট সুশাসন। বিশ্বব্যাংকের মতে, ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের অভ্যাস এবং ঋণ অবলোপন করার প্রবণতা বেড়েছে, যা ব্যাংক খাতে চাপ সৃষ্টি করছে। ঢালাওভাবে ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
এ অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার তাগিদ দেয় বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমিত স্বাধীনতা এবং আইনবিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের অভাবে ব্যাংক খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মালিক জনগণ। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মালিকানার ভূমিকা পালন করে। নিয়ন্ত্রক ও মালিকের ভূমিকা এক নয়। তাই আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অনুষ্ঠানে বলেন, ফাউল প্লে করলে রেড কার্ড, ইয়েলো কার্ড আছে। সে জন্য রেফারি আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব রেফারির মতো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি দক্ষতা, স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তবে কোনো সমস্যা হয় না।
ব্যাংক খাতসংশ্নিষ্টরা জানান, কাঙ্ক্ষিত মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রাখার লক্ষ্যে অনেক ভেবেচিন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। তবে নজিরবিহীনভাবে গত বছরের ১ এপ্রিল ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির সঙ্গে পাঁচতারকা হোটেলে বসে বৈঠক করে সিআরআর কমানোর ঘোষণা দেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সিআরআর সংরক্ষণের হার সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে তখন সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়। মূলত আমানতকারীর সুরক্ষার জন্য এ অর্থ রাখতে হয়।
ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে সরকার। সংশোধিত আইনের আলোকে এক পরিবার থেকে চারজন এবং পরিচালক পদে টানা নয় বছর থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। এই সংশোধনীর বিপক্ষে মত দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন বলেছিল, এমনটি হলে পরিচালকদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুরূহ হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ সম্পর্কিত ধারা পাঁচবার সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সংশোধিত আইনে দুই মেয়াদে ছয় বছর পরিচালক থাকার বিধান যুক্ত করা হয়। এভাবে প্রভাবশালীরা চাইলেই যে কোনো কিছু পেয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতামত পাশ কাটিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দুর্বল হচ্ছে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে পরিচালকদের অনিয়মে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অবসরের পর বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে বর্তমানে ডজনখানেক কর্মকর্তা কাজ করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরিতে থাকা অবস্থায় নানাভাবে এসব কর্মকর্তা ওইসব বেসরকারি ব্যাংককে সুবিধা দিয়েছেন। পরে নানা তদবির নিয়ে তারা আসেন আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন কর্মকর্তারা। এ রকম ঘটনা তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দীর্ঘদিন পরিদর্শন বিভাগে কাজ করে ২০১৬ সালে নির্বাহী পরিচালক পদে থেকে অবসরে যাওয়া সাইফুল ইসলাম খান। অবসর-পরবর্তী সংবর্ধনায় গভর্নরের উপস্থিতিতে তিনি একটি ঘটনা তুলে ধরে বলেন, একটি পরিদর্শন বিষয়ে একবার তার কাছে তিন দফা তদবির এসেছে। এমন ব্যক্তি তদবির করেছেন, যিনি এক সময় তার বস ছিলেন। চক্ষুলজ্জার খাতিরে শেষ পর্যন্ত ওই পরিদর্শন কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য এটা বিব্রতকর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এ নিয়ে নিজের হতাশার কথা তুলে ধরে বলেন, অবসরের পর বাণিজ্যিক ব্যাংকের চাকরির বিষয়টি তাদের জন্য বিব্রতকর। এক সময় যারা তাকে ‘স্যার’ ডাকতেন, এখন তাদের স্যার ডাকতে হয়। তবে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে যে, বড় প্রতিষ্ঠানের ঋণ জালিয়াতি বা বেনামি ঋণের তথ্য ধরতে গিয়ে অনেক সময় নিজেদেরই বিপদে পড়তে হচ্ছে। নানা উপায়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চাপে ফেলা হচ্ছে। এ পরিস্থিতির উন্নয়ন দরকার।