টানা ব্যাটিং ব্যর্থতার খেসারত দিতে হচ্ছে দলকে, চট্টগ্রাম টেস্টে রানে ফিরতে মরিয়া মুশফিক-শান্তরা।
থ্রো-ডাউনে একটি ডেলিভারি ঠিকঠাক খেলতে না পেরে একটু জোরেই চিৎকার করে উঠলেন মুশফিকুর রহিম। তার হতাশার আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকালেন মাঠের আরেক প্রান্তে বসে থাকা এইডেন মার্করাম। মুশফিককে দেখে হয়তো কিছুটা অবাকও হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। বাংলাদেশ দলের অনুশীলন শুরু হতে যে তখনও বাকি ঘণ্টা দুইয়ের বেশি সময়!
মার্করাম চমক গেলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটি নতুন কিছু নয়। দলীয় অনুশীলনের আগে নিয়মিতই আলাদা অনুশীলন করে নেন মুশফিক। রোববারও ব্যতিক্রম নয়। দলের অনেক আগেই ব্যক্তিগত অনুশীলনে জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে চলে আসেন তিনি। পরে দলীয় অনুশীলনেও যথারীতি ঝালিয়ে নেন নিজেকে। মিরপুর টেস্টে দুই ইনিংসেই দৃষ্টিকটূভাবে বোল্ড হয়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। চট্টগ্রামে তার ব্যাটে আবার ভরসা খুঁজবে দল।
শুধু মুশফিকই অবশ্য নয়, সিরিজ হার এড়াতে হলে চট্টগ্রাম টেস্টে দারুণ কিছু করতে হবে পুরো দলকেই। মিরপুরে মূলত ব্যাটিং ব্যর্থতায় হেরেছে বাংলাদেশ। পরের টেস্টে তাই ব্যাটসম্যানদের ভালো করার দায়টা বেশি। চট্টগ্রামে আসার পর দলের প্রথম অনুশীলনে দুর্দশা কাটানোর চেষ্টার ছাপই যেন পড়ল বেশি। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তকে দেখা যায় ব্যাটিং কোচ ডেভিড হেম্পের সঙ্গে নিবিড় আলোচনা করতে।
দলের অনুশীলন দুপুরে থাকলেও বেলা ১১টাতেই মাঠে চলে আসেন মুশফিক। টিম বয় ও নেট বোলার নিয়ে শুরু করেন নেট সেশন। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে তার ব্যক্তিগত অনুশীলন পর্ব।
পাকিস্তান সফরের প্রথম টেস্টে ১৯১ রানের ইনিংসের পর থেকেই হাসছে না মুশফিকের ব্যাট। সবশেষ চার ম্যাচের আট ইনিংসে চল্লিশ ছুঁতে পারেননি ৩৭ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। সীমানা আরেকটু বাড়িয়ে ১৫ ম্যাচ বিবেচনায় নিলে, ওই ১৯১ ছাড়া তার পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস আছে আর একটি। সবশেষ চার ইনিংসেই তিনি ফিরেছেন বোল্ড হয়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ ড্র করার অভিযানে জিততে হলে ব্যাটিংয়ে ভালো করার বিকল্প নেই বাংলাদেশের। সেই লক্ষ্য পূরণে বড় দায়িত্ব মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান মুশফিকের। তাই দুঃসময়ের আঁধার পেরিয়ে আলোর খোঁজই যেন করছেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
একইভাবে ছন্দহীনতায় ভুগছেন অধিনায়ক শান্তও। সবশেষ ১৫ ইনিংসে তিনি চল্লিশ ছুঁতে পেরেছেন মোটে একবার। স্পিনার হোক বা পেসার, বাজে শটে আউট হচ্ছেন প্রায় নিয়মিত।
শান্ত-মুশফিকসহ ওপরের সারির ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার প্রভাব পড়ছে দলের সামগ্রিক ব্যাটিংয়ে। চলতি বছর সাত টেস্টে মাত্র তিনবার তিনশ ছুঁয়েছে বাংলাদেশের স্কোর। ঘরের মাঠের অবস্থা আরও নাজুক। সবশেষ আট ইনিংসে দুইশ রান হয়েছে মোটে দুইবার।
ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টায় অনুশীলনে ভিন্ন নানা কিছু করতে দেখা যায় শান্তকে। তার ব্যাটিংয়ের প্রায় পুরোটা সময় সামনে থেকে দেখেন হেম্প। শুরুতে স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট মাপের ব্যাট দিয়ে স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটিং করতে দেখা যায় বাংলাদেশ অধিনায়ককে। এ সময় কাছে দাঁড়িয়ে তাকে বিভিন্ন পরামর্শ দেন ব্যাটিং কোচ।
নেট বোলারের একটি ডেলিভারি ঠিকঠাক খেলতে না পেরে নিজের ওপর বিরক্ত হন শান্ত। সহকারী কোচ নিক পোথাস তখন এগিয়ে এসে তাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করেন। সেই পরামর্শ যে কাজে লেগেছে, তা বোঝা যায় পরের ডেলিভারিগুলোতে শান্তর ব্যাটিংয়ের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে দেখে।
এরপর হাসান মাহমুদ, সৈয়দ খালেদ আহমেদ, নাহিদ রানাদের পেস বোলিং বেশ ভালোভাবে সামলান শান্ত। এ সময় অন্য প্রান্তে দাঁড়ান মেহেদী হাসান মিরাজ। কয়েকটি ডেলিভারি পরপর স্ট্রাইক পরিবর্তন করে ব্যাটিং করতে থাকেন তারা দুজন।
সবশেষে স্পিনারদের নেটে গিয়ে বেশ কিছু বড় শটও খেলেন শান্ত। তার পাশের নেটে তখন নাহিদের একটি ডেলিভারি জাকের আলির হেলমেটে লাগলে মুহূর্তের জন্য শঙ্কা জাগে। তবে কিছুক্ষণ পরই আবার সাবলীলভাবে ব্যাটিং করতে থাকেন মিরপুরে টেস্ট অভিষেকে ফিফটি করা ব্যাটসম্যান।
ব্যাটিং অনুশীলন শেষ করে শুরু হয় প্রধান কোচ ফিল সিমন্সের সঙ্গে শান্তর দীর্ঘ আলোচনা। তখন পর্যন্ত চট দিয়ে ঢাকা ছিল উইকেট। কোচ ও অধিনায়ক সেদিকে যেতেই তুলে দেওয়া হয় কাভার। হাঁটু গেড়ে হাত দিয়ে উইকেট ধরে বোঝার চেষ্টা করেন শান্ত। মাঠের কিউরেটর জাহিদ রেজা বাবুও তখন যোগ দেন তাদের আলোচনায়।
দীর্ঘ ব্যাটিং সেশন শেষ করে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই সেন্টার উইকেটে প্রধান কোচ, অধিনায়ক ও কিউরেটরের সঙ্গে যোগ দেন মুশফিক। চার জন মিলে প্রায় ২০ মিনিট ধরে উইকেটের পাশে চলে আলোচনা। পরে মুশফিক ও জাহিদ রেজা সরে এলেও শান্ত ও সিমন্সের কথোপকথন চলছিল তখনও।
সেন্টার উইকেটে যখন এই দীর্ঘ আলোচনা চলমান, তখন ড্রেসিং রুমের সামনে নিরাপত্তা মহড়া পরিচালনা করছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। সংবাদমাধ্যমের নজর তখন সেদিকেই ছিল। সেন্টার উইকেট থেকে সেদিকে এসে মজার চলেই জাহিদ রেজা বলেন, ‘ভালোই হলো, উইকেট নিয়ে আমাদের আলোচনা কেউ খেয়াল করেনি!’
সঙ্গত কারণেই উইকেট নিয়ে কোনো ধরনের তথ্য দিতে রাজি হননি বিসিবির অভিজ্ঞ কিউরেটর। তবে পরে বিসিবির ভিডিওবার্তায় অফ স্পিনার নাঈম হাসান বলেন, স্পিন সহায়ক উইকেট আশা করছেন তারা।
“উইকেট আমি দেখিনি, যদি স্পিন সহায়ক হয়, তাহলে তো টার্ন হবে। আমাদের এই মাঠে বল একটু আস্তে ঘোরে, যেটা আমাদের জন্য ভালো। কারণ ওরা তো মিরপুরে অনেক আস্তে বোলিং করেছে, আমাদের স্পিনাররা তো ৯০-এর ওপর (কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা) বোলিং করে। ওই হিসেবে আমাদের দিক দিয়ে ভালো।”
স্পিন সহায়ক উইকেট হলে কেশাভ মহারাজ, ডেন পিটদের সামলানোর চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে ব্যাটসম্যানদের। বিকেলের আলো যখন নিভু নিভু, তখন যেন সেই প্রস্তুতিই নেওয়ার চেষ্টা করেন মুমিনুল হক। বাকিরা ড্রেসিং রুমে চলে যাওয়ার পর এক টিম বয়কে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সুইপ আর রিভার্স সুইপের অনুশীলন করেন অভিজ্ঞ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে প্রথম দিনের অনুশীলনে ব্যাটিংয়ে বাড়তি মনোযোগীই দেখা যায় পুরো দলকে। এমনকি লেজের দিকে ব্যাটসম্যানরাও প্রত্যেকে প্রায় ত্রিশ মিনিট করে ব্যাটিং করেন নেটে।
টেস্ট শুরুর আগে আরও একদিন নিজেদের শাণিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন ব্যাটসম্যানরা। এরপর মঙ্গলবার শুরু মূল পরীক্ষা। টেস্ট জিততে হলে ২০টি উইকেট নিতে হবে, এটিই সবসময়ের সত্যি। তবে কিছু রানও তো অন্তত করতে হবে!