রাসেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ

image-826282-1720557665

পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় যুগান্তরের সাংবাদিক রফিকুল ইসলামকে মারধরের ঘটনায় রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল আসাদ রাসেলের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাকে শোকজ করার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া রাসেলকে এখন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দলীয় সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রবেশ না করতে দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।

এদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথসভার আগে নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় রফিকুল ইসলামকে মারধরে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াকে নির্দেশ দেন রাসেলকে শোকজ করতে। ওবায়দুল কাদের বলেন, এর আগেও তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এসেছে, সে (রাসেল) আমার নাম ব্যবহার করেও নাকি অপকর্ম করছে।

রাজনীতি না করেও বড় পদে রাসেল : রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের সাঙ্গুড়া গ্রামে জন্ম রাসেলের। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করেন নলিয়া শ্যামামোহন ইনস্টিটিউশন থেকে। এলাকায় রাজনীতির সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলেন না। তা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পান তিনি। সূত্র জানায়, ২০০০ সাল থেকে উত্থান রাসেলের। সেই সময় থেকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় অফিসে আসা-যাওয়া শুরু করেন। শুরু হয় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সেলফি তোলা। সেগুলো নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে বিভিন্ন দপ্তরে তদবির বাণিজ্য শুরু করেন।

জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসায় অবাক হয়েছেন তার জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীরা। তাদের ভাষ্য-জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসতে হলে প্রথমে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অথবা সহযোগী সংগঠনের রাজনীতি থেকে যেকোনো মানুষকে নেতা হয়ে আসতে হয়। কিন্তু রাসেল রাজবাড়ীর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী লীগের কোনো পদে ছিলেন না। তারপরও হঠাৎ করেই বাগিয়ে নিয়েছেন রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ। অভিযোগ রয়েছে, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার আস্থাভাজন রাসেল। সে কারণেই জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসেন তিনি।

সাংগুড়া গ্রামে প্রতিবেশী মো. সোবাহান শেখ বলেন, রাসেলকে আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে দেখা যায়নি। পরে জানতে পারি ঢাকায় গিয়ে বড় বড় নেতার সঙ্গে ছবি তুলে বড় নেতা হয়েছেন।

জামালপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা কামরুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন। ফরিদ হোসেন মিয়া বাবুসহ অনেকেই দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, কোনো পদই জোটেনি। অথচ রাসেলের মতো সন্ত্রাসী একটা ছেলে বাগিয়ে নিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ। এসব ভাবতেই এখন অবাক লাগে!

তদবিরবাজি ও পদবাণিজ্য : আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে দু-চারজন কেন্দ্রীয় নেতাকে প্রটোকল দেওয়া আর তাদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে নিজেকে বড় নেতা হিসাবে জাহির করত রাসেল। ঢাকায় থাকলেও বাগিয়ে নেন জেলা আওয়ামী লীগের পদ। দলীয় পদ এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি দেখিয়ে চলে তার তদবিরবাজি। আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের পদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ম্যানেজ করে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার বিস্তর অভিযোগও রয়েছে রাসেলের বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, রাসেল আমাকে পদ দেওয়ার কথা বলে টাকাও চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। কিন্তু আমি এত টাকা দিতে পারিনি। তবে আমি কিছু টাকা দিয়েছিলাম। চা-কফি খাওয়ার জন্য কিছু রেখে তিনি তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

হঠাৎ কোটি টাকা সম্পদের মালিক : মঙ্গলবার দুপুরে বালিয়াকান্দির জামালপুর ইউনিয়নের সাঙ্গুড়া গ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে উঁচু করা মাটির স্তূপ। ফসলি জমির মাটি তুলে বাড়ির রাস্তা করার উদ্দেশ্যে তা রাখা হয়েছে। জামালপুর বাজারে রাসেলের একটি দোকান রয়েছে। সেই দোকানের মূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার সাঙ্গুড়া মাঠে কয়েক একর জমি রয়েছে রাসেলের। যার মূল্য প্রায় কোটি টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, রাসেলের অপকর্ম সম্পর্কে ভয়ে এলাকায় কেউ কথা বলে না। শুনেছি তার হাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সখ্যের কারণেই ভয়ে চুপ থাকে এলাকার মানুষ। হঠাৎ করেই অনেক সম্পদের মালিক বনে গেছেন।

জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বালিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ কে এম ফরিদ হোসেন বাবু বলেন, দেশের সাংবাদকর্মীরা হলো জাতির বিবেক। তাদের গায়ে হাত তোলা ন্যক্কারজনক ঘটনা। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

রাজশাহী বিভাগ সাংবাদিক সমিতি, ঢাকার উদ্বেগ : রাজশাহী বিভাগ সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা রফিকুল ইসলামের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক দীপক দেব এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় জড়িত দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

সিসাসের নিন্দা : এ হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সিরাজগঞ্জ সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা (সিসাস)। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সমিতির সভাপতি তৈমুর ফারুক তুষার ও সাধারণ সম্পাদক কাওসার আজম বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের হামলা স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের গৌরবময় ঐহিত্যের অধিকারী দল আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে একজন সাংবাদিকের ওপর হামলা অত্যন্ত দুঃখজনক।

প্রসঙ্গত, সোমবার আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সংগ্রহে যান রফিকুল ইসলাম। এ সময় তার (সাংবাদিকের) ওপর অতর্কিত হামলা করে রাসেল এবং সঙ্গে থাকা ক্যাডার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য। উপর্যুপরি কিল-ঘুসি দিতে থাকে তারা। পরে আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা এগিয়ে এলে রাসেল ক্যাডার বাহিনী নিয়ে সরে পড়ে। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকরা এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানান।

Pin It