তিন বছরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থ সুদসহ ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘটনার সময় ফিলিপাইনের অভিযুক্ত ব্যাংক আরসিবিসির সিসিটিভি বন্ধ থাকা, ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরসিবিসিকে জরিমানা, দেশটির আদালতে শাখা ব্যবস্থাপককে শাস্তি এবং এফবিআইর তদন্তের ফলে ওই ব্যাংকের দায় প্রমাণে তেমন বেগ পেতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে মামলার পর রোববার সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিএফআইইউপ্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি ও উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ।
এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নিউইয়র্কের আদালতে মামলায় মূল বিবাদী ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি)। এ ছাড়া আরও ছয়টি প্রতিষ্ঠান, ১৫ ব্যক্তি এবং ২৫ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। ফিলিপাইনের সংসদের কমিটি, সিনেটসহ বিভিন্ন তদন্তে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে।
আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম থেকে সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ ফেরতের চেষ্টা করছিল। সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থ উদ্ধার বাবদ টাকা খরচ নিয়ে অনেকের কৌতূহল আছে। মামলা না করলে জনগণের কাছে জবাবদিহির কোনো উপায় থাকবে না। অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে তিন কোটি টাকার কম খরচ হয়েছে। দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, টাকা খরচ এখানে বড় কথা নয়, টাকা উদ্ধার বড় বিষয়। এ জন্য শ্রম দিয়ে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, প্রথমে চেষ্টা করা হয়েছিল, নিউইয়র্ক ফেডকে সঙ্গে নিয়ে মামলা করা হবে। তবে নীতিগত কারণে ফেড মামলায় বাদী হতে পারেনি। পুরো অর্থ ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত সব ধরনের সহযোগিতার বিষয়ে ফেড একটি চুক্তি করেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মামলার অভিযোগ একশ’ তিন পৃষ্ঠার। যেখানে চারশ’ প্যারাগ্রাফ রয়েছে। এর মধ্যে দুইশ’ প্যারাগ্রাফ আরসিবিসির বিরুদ্ধে।
মামলাটি রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি বলে আরসিবিসির বক্তব্যের জবাবে এই আইনজীবী বলেন, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চুরির অর্থ আরসিবিসির শাখায় পৌঁছায়। আরসিবিসির ডকুমেন্ট থেকে জানা গেছে, ৪ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি রাত পর্যন্ত ওই শাখার সিসিটিভি বন্ধ ছিল। আরেকটি বিষয় হলো, ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার পর্যন্ত ছিল তাদের ব্যাংকিং ডে। এরপর থেকে তিন দিন বন্ধ ছিল। অথচ রহস্যজনকভাবে বন্ধের মধ্যে রোববার সুইফট সার্ভার বন্ধ করে দেওয়া হয়। যেহেতু বাংলাদেশে ওই দিন ব্যাংকিং ডে ছিল। এ জন্য হয়তো তারা ভেবেছে, সুইফটের মাধ্যমে বাংলাদেশে কোনো মেসেজ চলে যেতে পারে।
তিনি বলেন, মামলার সব প্রক্রিয়া শেষ হতে কতদিন লাগবে বলা কঠিন। তবে ওই দেশের আইনজীবীসহ সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তিন বছরের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তিতে মামলা চলা অবস্থায় বিভিন্ন পক্ষের অনেক ধরনের আবেদন আসবে। এটা বুঝেশুনেই আইনজীবীর মতামত নিয়ে সেখানে মামলা করা হয়েছে। মামলার আগে ফেডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তির আওতায় পুরো অর্থ ফেরত না আসা পর্যন্ত ফেড বাংলাদেশকে কয়েকটি বিষয়ে সহযোগিতা দেবে। সুইফটও বাংলাদেশকে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছে। এ ছাড়া ফিলিপাইনে চলমান মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের টিমের সঙ্গে ফেডের একটা দল সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে। ফেডের সঙ্গে এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগেছে। আবার আরসিবিসি থেকেও কৌশলে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারসহ অভ্যন্তরীণ আলোচনা করতে হয়েছে। এ জন্য মামলার জন্য সময় লেগেছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে আজমালুল হোসেন বলেন, সরকার গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন কোনো আইনি ভিত্তি নয়। এখানে কী ঘটেছিল, তা সরকার জানার জন্য হয়তো তদন্ত কমিটি করেছিল। সেখানে কী আছে, না আছে- তা কোনো বিষয় নয়। তবে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর তদন্ত এবং ফিলিপাইনের আদালতের যে রায় হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের কারও জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। আবার মামলার আগে আইনজীবী হিসেবে তিনিও এ ধরনের কোনো আলামত পাননি।
তৃতীয় দেশে মামলা করার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, তৃতীয় দেশের বাইরে বাংলাদেশ বা ফিলিপাইনে এ মামলা করতে হতো। তবে বাংলাদেশে মামলা করা হলে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। আবার ফিলিপাইনে এ ধরনের মামলা শেষ হতে তিন দশকের মতো সময় লাগতে পারে। অর্থ ফেরত পেতে এতদিন অপেক্ষা করা কঠিন। যে কারণে বিকল্প পন্থায় এগোনো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ মামলা করা হয়েছে। তিনি জানান, টাকাটা গেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের একটি চুক্তি রয়েছে। ওই চুক্তির আওতায় এক দেশের রায় অন্য দেশ মানতে বাধ্য। বিশ্বের যে কোনো দেশের রায় আরেক দেশে বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া রয়েছে। ফলে আরেক দেশে মামলায় কোনো সমস্যা হবে না। এ ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বেশির ভাগেরই সম্পদ রয়েছে।