রিজার্ভ রেমিট্যান্সে স্বস্তি, ধাক্কা রপ্তানি ও বিনিয়োগে

image-209869-1609111895

বছরজুড়েই করোনার প্রকোপ থাকায় ২০২০ সালটি বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক ছিল না। এর মধ্যেও দেশে তুলনামূলক শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও কৃষি খাত। তবে আবার রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে নতুন বছর চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হচ্ছে।

বৈশ্বিক করোনার গতিপথ কোন দিকে যায়, তার ওপরই নির্ভর করছে আগামীর অর্থনীতি। রেমিট্যান্সে গতি ফিরলেও রাজস্ব আদায় মন্থর হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেড়েছে সরকারের ঋণ। বাধ্য হয়ে কৃচ্ছ তা সাধনের নীতিতে হাঁটছে সরকার। অর্থনীতির গতি ফেরাতে দ্বিতীয় প্রণোদনা নিয়ে ভাবছে সরকার। বিশ্বমন্দার এই সময়ে স্থবির হয়ে পড়া ব্যবসা-বাণিজ্য আগামী দিনগুলোতে আরো অনিশ্চয়তায় পড়বে এমন আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি :এবারের বাজেটে স্বভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে আদায়ের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছিল ২ লাখ ১৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

এনবিআরের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে রয়েছে ২৫ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে বিপুল রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়ায় ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। করোনার প্রভাবে সার্বিকভাবে ব্যবসায় ও শিল্পোৎপাদনে গতি নেই। ফলে স্বভাবতই রাজস্ব আদায়ে আগের বছরের মতো গতি নেই। সেই বিবেচনায় রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি আরো কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। অথচ এবার এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫১ শতাংশ। এত বিশাল রাজস্ব আদায় করা বাস্তবে সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। সেক্ষেত্রে চলতি বছরও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ৮০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, এবারের রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রায় বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায়ে বেশি ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির হিসাবে বলা হয়েছিল, রাজস্ব আদায়ে ১ লাখ কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে।

ফের কমে গেছে রপ্তানি আদেশ

বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। করোনার প্রথম ধাক্কা কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ে টালমাটাল ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল। এর মধ্যেই যুক্তরাজ্যে নতুন ধরনের করোনা শনাক্তের খবরে উদ্বেগ আরো বেড়েছে। করোনার প্রথম ধাক্কায় মার্চ থেকে রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমলেও জুলাই থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছিল। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকার পর অক্টোবর থেকে ফের কমতে শুরু করে তৈরি পোশাক রপ্তানি। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বরের প্রথম ২০ দিনে এ খাতের রপ্তানি কমে গেছে সোয়া পাঁচ শতাংশ। বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সার্বিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ সময় রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৫৯২ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের (১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা) পণ্য। পূর্বের অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য। সরকারি লক্ষ্য অনুযায়ী রপ্তানি আয় করতে হলে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর শেষে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের (৪ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা) রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে।

বিদেশি বিনিয়োগে বড় ধাক্কা

মহামারি করোনার বড় ধাক্কা এসেছে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই)। বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেনের ভারসাম্যের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশে ৫৪ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই হিসাবে এই তিন মাসে মোট এফডিআই কমেছে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২০ সালের প্রথম তিন মাস, অর্থাত্ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে কিছু বিনিয়োগ এলেও পরের দুই মাস এপ্রিল ও মে বিনিয়োগশূন্য থাকে। সে সময় চলা লকডাউনের কারণে সারা বিশ্বই কার্যত অচল হয়ে যায়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হয় ৫৮ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ৩৬১ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি ডলারে।

উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে এই হার সর্বনিম্ন। এই পাঁচ মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পেরেছে ৩৮ হাজার ৪৭২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৪১ হাজার ৩৮৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পাঁচ মাসে সর্বনিম্ন ১৭ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল। করোনার প্রভাবে বছরের শুরুতে কার্যত সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। অর্থবছরের শুরুতে কিছু গতি পেলেও ব্যয় কমিয়ে বাজেট সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এবারের বাজেটে প্রকল্পের সংখ্যা সীমিত রাখা, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিয়ে অগ্রাধিকার প্রকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া, বরাদ্দবিহীন কোনো প্রকল্প না রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে।

স্বস্তি রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সে

তবে করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন। গত নভেম্বরে তারা ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে ১ জানুয়ারি থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে এসেছে ২ হাজার ৫০ কোটি ডলার (১ লাখ ৭৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা), যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশে এত রেমিট্যান্স আর কখনো আসেনি। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। রেমিট্যান্সের প্রবাহ চাঙ্গা থাকায় ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে (৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা)। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়াকে নির্দেশ করে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মজুত থাকলে ঝুঁকিমুক্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। বাংলাদেশের কাছে এখন যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে, তা দিয়ে আট মাসের বেশি আমাদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার এই সময়ে পারিবারিক প্রয়োজনে প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে অর্থ পাঠিয়েছেন। তাছাড়া সরকারঘোষিত ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার কারণেও বৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়েছে। আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ার ফলেও রিজার্ভ বেড়েছে।

Pin It