বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক তৎপরতা সম্পর্কে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ যে বক্তব্য দিয়েছেন তাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
তবে বিএনপির পক্ষ থেকে লাভরভের বক্তব্য প্রসঙ্গে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে।
সের্গেই লাভরভ বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন এবং সংক্ষিপ্ত সফর শেষে শুক্রবার দুপুরে দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বাংলাদেশে এ সফরে ওই দিন রাতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এবং পর দিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন লাভরভ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি কিছু আন্তর্জাতিক প্লেয়াররা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট দলের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে- যেটা সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক আচরণ ও অগ্রহণযোগ্য। রাশিয়া ও বাংলাদেশ একসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধুদের চাপের ভেতরেও বাংলাদেশ তাদের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো চমৎকারভাবে পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন, রাজনীতিসহ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তৎপরতা এবং মন্তব্য প্রায়ই শোনা গেলেও বাংলাদেশের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে সম্পৃক্ত রাশিয়ার দিক থেকে কোনো কথা বলা হয় না।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল রাশিয়া (তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন) যা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ৷ এমনকি যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে বাংলাদেশকে যুদ্ধে সহযোগিতায়ও প্রস্তুত ছিল দেশটি ৷
স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে ও সহযোগিতায় রাশিয়া এগিয়ে আসে৷ বিশেষ করে পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর বঙ্গোপসাগরে পেতে রাখা মাইন পরিষ্কার করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর সচল করার দুরূহ কাজটি করে দেয় রাশিয়ার নৌবাহিনী।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের এই মাইন অপসারণ সদ্য স্বাধীন এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন জন্য ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি জরুরি যেটি অন্য কোনো দেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে ছিল অসম্ভব।
১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান বদলে যায়৷ দীর্ঘপথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গুরুত্ব পেতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য সহযোগিতার পাশাপাশি দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র) বাস্তবায়নে কাজ করছে রাশিয়া। আর এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সব চেয়ে বড় ও সর্বোচ্চ ব্যয় বহুল প্রকল্প যেটির মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিশ্বে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে।
তবে দীর্ঘদিন উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো কথা বলেনি রাশিয়া৷ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৷
২০১৪ ও ২০১৮ সালের এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগে ও পরে আওয়ামী লীগকে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে অনেক ধকল পার করতে হয় ৷
আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ বিশ্বের বড় বড় শক্তি ধর রাষ্ট্র ও তাদের মিত্র কিছু দেশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করছে এবং শেখ হাসিনার সরকারকে সরাতে দীর্ঘদিন ধরেই তৎপর রয়েছে ৷
এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা এ দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে উসকে দিচ্ছে ৷ আবার নির্বাচন ও আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে কোনো কোনো দেশের প্রকাশ্য তৎপরতাও ছিল লক্ষণীয় ৷ তবে এসব বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কখনও প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি।
এদিকে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ আগে থেকেই আন্তর্জাতিক তৎপরতা দৃশ্যমান রয়েয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এই নির্বাচন, মানবাধিকার ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষিয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে কয়েকবার ঢাকায় এসেছে এবং সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ও পক্ষের সঙ্গে কথা বলে মতামত দিয়েছেন। তাদের এই তৎপরতা ও বক্তব্যকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।
গত ৬ জুলাই জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে আমাদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। আমেরিকায় তো প্রতিদিন গুলি করে করে শিশুদের হত্যা করছে স্কুলে যেয়ে, শপিংমলে হত্যা হচ্ছে, রাস্তায় হত্যা হচ্ছে, এমনকি আমাদের বাঙালি মেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, তাকে হত্যা করেছে। আর প্রতিদিন তো তাদের প্রতিটি স্টেট, এক এক একটা স্টেটে দেখা যাচ্ছে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। ঘরের মধ্যে গিয়ে পরিবারসহ হত্যা করে আসছে। নিজের দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা আগে তাদের করা উচিত।
এদিকে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের তৎপরতা শুরু হলে গত বছর ডিসেম্বরে ঢাকায় রাশিয়ার দূতাবাস থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘কিছু দেশ যারা নিজেদের উন্নত গণতন্ত্র বলে দাবি করে অন্য সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু হস্তক্ষেপই করে না এমনকি ব্ল্যাকমেইলও করে। ’
এর পর বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে কথা বললেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে রাশিয়া যে সহযোগিতা করেছিল তার মধ্য দিয়েই দুই দেশের বন্ধুত্বে ভিত তৈরি হয়, শেখ হাসিনা সেটা ধরে রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল তার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের প্রতি রাশিয়ার বন্ধুত্ব, সহযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত রয়েছে ৷
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখন সবচেয়ে আশঙ্কার কথা- রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে এসে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাংলাদেশ বড় শক্তিগুলোর মর্যাদার লড়াইয়ে, তাদের ক্ষমতার বলয়ের একটা ক্ষেত্রে হিসেবে ব্যবহৃত হতে চলেছে। এর জন্য বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ দায়ী।
তবে বিএনপির এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, এতো দিন বড় বড় দেশগুলো যে কথা বলেছে ও বলে আসছে সেগুলোকে বিএনপি কখনও নেতিবাচক বা বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেনি। কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও দেয়নি। বরং বিএনপি ওই দেশগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে আসছে। এখন তারা ওই সব দেশ সম্পর্কে সমালোচনাকে আশঙ্কা হিসেবে দেখছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাব ফেলবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, দেশটির সঙ্গে আমাদের দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করি। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো ঠিকই বলেছেন। এখানে মির্জা ফখরুল এতে গন্ধ পেলেন কোন জায়গায়।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, বিএনপি তো বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দিয়েছিল। দুর্নীতিতে ৫ বার চাম্পিয়ন, জঙ্গিবাদ সৃষ্টিসহ সব দিক থেকে ধ্বংস করেছিল। সেখান থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উদ্ধার পেয়েছে। জি-২০ তে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রিত- এমনটি হয়নি। এটা দেশের জন্য মর্যাদার বিষয়। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সবচেয়ে নিরাপদে রেখেছেন। বিএনপির মুখে বড় বড় কথা মানায় না, শেখ হাসিনার কূটনীতি বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই।