লকডাউন নিয়ে বিশৃঙ্খলা

image-254228-1624479832

দেশে লকডাউন নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কোন ধরনের চিন্তা-ভাবনা না করে ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় লকডাউন ঘোষণা করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে জনসাধারণ। লকডাউন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিপাকে পড়েছে।

সাত জেলায় লকডাউনে ঢাকার সঙ্গে যান চলাচল বন্ধ। এতে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে মানুষের স্রোত। বিকল্প উপায়ে ঢুকছে ও বের হচ্ছে মানুষ। এতে তাদের যেমন ভোগান্তি হচ্ছে, তেমনি গুণতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। উপেক্ষিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি। চট্টগ্রাম, সিলেট, উত্তরবঙ্গ কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে যখন কোন মানুষ ঢাকার প্রবেশ মুখ পর্যন্ত চলে আসছে, তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সেখান থেকে আবার ফেরত পাঠাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে তাদের ঢাকায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, এই ধরনের লকডাউন করা মানে উল্টো সংক্রমণ বাড়িয়ে দেওয়া।

করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। রাজধানীতে সংক্রমণ বাড়ছে দ্বিগুণ হারে। অধিকাংশই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। সামনে কোরবানির ঈদ ও পশুর হাটকে কেন্দ্র করে সংক্রমণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধির আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানী ঢাকাকে সুরক্ষিত করতে গিয়ে উল্টো বিশৃঙ্খলায় সংক্রমণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, কমপক্ষে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা আগে ঘোষণা দিয়ে লকডাউন শুরু করা উচিত ছিল। হুট করে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও গ্রহণ করা হয়নি। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে।

সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, রাজধানীতে করোনা সংক্রমণ দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। সব ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। তবে যে প্রক্রিয়ায় ঢাকাকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে সফল হওয়া যাবে না। বরং এতে সংক্রমণও বাড়বে, মানুষের দুর্ভোগও চরম পর্যায়ে যাবে। সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়ে পেছনে দৌঁড়ে লাভ হবে না। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে যে যেখানে আছেন, সেখানেই আসন্ন কোরবানির ঈদ উদযাপন করতে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব ব্যাপক হারে টিকা দিতে হবে। টিকা ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

কোভিড হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও কোভিড-১৯ গাইডলাইন কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ বলেন, দেশে লকডাউন দেওয়া উচিত ছিল গত ১৫ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। তাহলে দেশ উপকৃত হতো। আর লকডাউনে পরিবহন বন্ধ রাখা উচিত। তিনি বলেন, ঢাকা রক্ষা করতে সাত জেলায় লকডাউন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে সারাদেশে লকডাউন দেওয়া উচিত। সামনে কোরবানির ঈদ ও পশুর হাটকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করবে। যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ করতে হবে। এ বিষয়টি সবাইকে মানাতে বাধ্য করার পরামর্শ দেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘কোন ধরনের চিন্তা-ভাবনা না করে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এটা জনস্বার্থের সিদ্ধান্ত নয়, প্রশাসনের সিদ্ধান্ত। ইতিমধ্যে ঢাকায় অনেক করোনা রোগী ঢুকেছে। তাদের কী করবেন? তারা অন্যদের সংক্রমিত করছে। সকলের সমন্বয়ে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। যখন শুরুতে সীমান্তে সংক্রমণ বাড়ছিল, তখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।

সীমান্তের এক জেলায় টানা দুই সপ্তাহ লকডাউন দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে যাতায়াতও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সংক্রমণ চারদিকে ছড়িয়ে পিছনে দৌড়ালে ফলাফল কী হবে? তিনি বলেন, ভারতে দেশটির ১৮৯৭ সালের সংক্রমণ ব্যাধি আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য বিভাগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, সেটির বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ কারণে দেশটি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে। আমাদের দেশে ২০১৮ সালের সংক্রমণ ব্যাধি আইন থাকলেও কেউই তা মানে না। সামনে কোরবানির ঈদ, পশুর হাট। অপরিকল্পিত লকডাউনে জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে। মনে রাখতে হবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এতটাই শক্তিশালী যে অধ্যাপক ডা. সাইফুল ইসলাম ডেভিড দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকা থেকে কাউকে বের হতে কিংবা প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। তাহলে সামনে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে। আর লকডাউন ঘোষণার আগেই বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। ঢাকার ভিতরে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন তিনি।

Pin It