ইতিহাসের নানা বাঁকে আওয়ামী লীগের ঝঞ্ঝামুখর সময় পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেছেন, শত আঘাত অতিক্রম করেই এগিয়ে যাবে তার দল।
৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সোমবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় একথা বলেন দলটির বর্তমান সভানেত্রী।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের ৭০ বছরে যে সংগ্রামের ইতিহাস এবং যে অর্জনের ইতিহাস, সেই অর্জনের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ আজ উজ্জ্বল।
“আওয়ামী লীগ এই উপমহাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সুসংগঠিত দল। যে দলকে শত আঘাতেও কেউ ছিন্নভিন্ন করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না ইনশাল্লাহ।”
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর এই দলটির বিস্তৃতি ঘটে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই স্বাধিকার আন্দোলন পেরিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ষড়যন্ত্রের ছকে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দলের নেতৃত্বে আসেন শেখ হাসিনা।
নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সাল থেকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৯ সালে পুনরায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তারপর এখন টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “আওয়ামী লীগের উপর বারবার আঘাত এসেছে, কারণ আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের মানুষের কথা বলেছে, জনগণের কথা বলেছে।”
বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ গঠনের যোগসূত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয় মীর জাফরের ষড়যন্ত্রে। ব্রিটিশ বেনিয়ারা এই দেশের ক্ষমতায় চলে আসে। আর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন।”
আওয়ামী লীগের সংগ্রামমুখর পথচলার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যেমন মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামগঞ্জ, যেখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী কারো বাড়িঘর ছিল না, সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার পঁচাত্তরের পরও সেই একই আঘাত। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, সেটা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
“আওয়ামী লীগের ইতিহাস যদি দেখি। কত আঘাত, কত ত্যাগ! আমার মনে হয় না কোনো রাজনৈতিক দল দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এত আত্নত্যাগ করেছে, যতটা আওয়ামী লীগ করেছে।”
এর পাশাপাশি নানা ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “এমনকি বেশি দূরে যেতে হবে না। আপনারা একটু চিন্তা করেন, ২০০৭ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসল, ক্ষমতায় তো ছিল বিএনপি। সাধারণত আমরা দেখি, যখন এরকম মার্শাল ল আসে, ইমারজেন্সি হয় বা কেউ ক্ষমতায় আসে, যারা ক্ষমতায় ছিল অর্থাৎ সদ্য অতীত, তাদের উপরে আঘাত আসার কথা।
“কিন্তু তখন আমাকে দেশে আসতে দেবে না। আমি যখন আসলাম জোর করে, আমাকে তখন গ্রেপ্তার করা হল। আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হল। তার অর্থটা কী, এখানেই বোঝা যায়। যেহেতু আমি জনগণের জন্য কাজ করি, কাজেই জনগণের অধিকার যারা কেড়ে নেয়, তাদের একটা দৃষ্টি থাকে আওয়ামী লীগের উপর যে এই দলটাকে আগে ধ্বংস কর।”
এই সব আঘাত আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করেছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “বলে যে হীরার টুকরা যত কাটে উজ্জ্বল হয়, আওয়ামী লীগও তাই হয়েছে।”
প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দল বিএনপির প্রসঙ্গ তুলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “তখন (২০০৮ সাল) সেই মইনুদ্দিন ফখরুদ্দিন ইয়েস উদ্দিন সবই তো খালেদা জিয়ার সৃষ্টি। তারাই ছিল ইমারজেন্সি সরকার। যখন তাদের অধীনে নির্বাচন হল, ৮৪ পার্সেন্ট ভোট পড়ল। খালেদা জিয়ার বিএনপি পেয়েছিল ২৯টা সিট। অর্থাৎ জনগণের বিশ্বাস, আস্থা তারা হারিয়েছিল।
“কারণ তাদের দুর্নীতি, এতিমের অর্থ আত্মসাৎ, গ্রেনেড হামলা, মানি লন্ডারিং, বাংলা ভাই সৃষ্টি, সন্ত্রাস সৃষ্টি, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি, সারা বাংলাদেশে ৫শ জায়গায় বোমা হামলা। আমাদের সংসদ সদস্য কিবরিয়া সাহেব, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ তাদের হত্যা। এই যে মানুষের সম্পদ লুট করে খাওয়া। হাওয়া ভবন খুলে দুর্নীতি করা। তাদের দুঃশাসনে মানুষ অতিষ্ঠ ছিল।”
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। এই উন্নয়নের গতিধারাটা অব্যাহত রাখতে হবে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি বিশ্বাস রেখেছে, ভোট দিয়েছে, নির্বাচিত করেছে। তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে।
“সরকারের ধারাবাহিকতা আছে বলেই আজকে এই উন্নয়ন আমরা করতে পেরেছি। আমরা অহমিকা করব না, মাটির সাথে মিশে চলব, মানুষের সাথে মিশে চলব। কিন্তু দেশের মানুষের যেন কল্যাণ হয় আর বাংলাদেশের মানুষ যেন আন্তর্জাতিকভাবে মাথা উঁচু করে মর্যাদার সাথে চলতে পারে সেই বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।”
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “যখন একেকটা অর্জন হয়, আমার মনে এটাই আসে, নিশ্চয়ই আমার বাবা দেখেন বাংলাদেশের মানুষ আর না খেয়ে থাকে না, তার বাংলাদেশের মানুষ এখন ছিন্ন বস্ত্র পড়ে না।
“আমাদের প্রতিজ্ঞা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ ঘর পাবে। কয়টা মানুষ ঘরহারা বা ভূমিহারা, সেটা হিসাব করে প্রতিটা মানুষকে ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। একটি মানুষ যদি কষ্ট পায়, আমি জানি আমার আব্বার আত্মা কষ্ট পাবে। কাজেই আমাকে এভাবে কাজ করতে হবে যেন এদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়।”
দেশকে এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করার উপর জোর দেন শেখ হাসিনা।
“আওয়ামী লীগ সংগঠন দিনের পর দিন যে শক্তি অর্জন করেছে, সেটা যেন আরও শক্তিশালী হয়। মুজিব আদর্শের আদর্শবান কর্মী হতে হবে এটাই আমি আওয়ামী লীগকে বলব। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এটাই মনে রাখতে হবে, আমাদের পূর্বসূরিরা যেভাবে আত্মত্যাগ করে গেছেন, ঠিক প্রত্যেকটা নেতাকর্মীকে জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। উচ্চমানের চিন্তাভাবনা করবে, সাধারণ জীবন-যাপন করবে। সাধারণ জীবন যাপনের মধ্য দিয়েই, ত্যাগের মধ্য দিয়েই অর্জন করা যায় “
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মো.নাসিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমানও বক্তব্য রাখেন।