বিশ্বমানবতার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত চিরকল্যাণকর এক জীবন বিধান হলো ইসলাম। ইসলামের অনুসারী মুসলিমদের জীবন-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ব্যক্তিগত সহনশীলতা, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শিক মূল্যবোধ, চরমপন্থার বিপরীতে মধ্যপন্থা অবলম্বন, সবার কল্যাণকামিতা ও সর্বক্ষেত্রে মানবিক ঔদার্যবোধের পরিচয় দেওয়া উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিপুল সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়া ইতিবাচক ও চিত্ত-সংশোধনের উপযোগী এবং দীর্ঘ ঐতিহ্যের পথ বেয়ে মুসলিম উম্মাহর পালন করে আসা অনুষ্ঠানাদি বিষয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা কোনো ধার্মিক মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। কিন্তু সম্প্রতি আমরা চরম দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, পবিত্র শবেবরাত নিয়ে ইউটিউব, ফেসবুকসহ যোগাযোগের নানা সামাজিক মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে; যা ধর্ম, ধার্মিকতা ও সুস্থ সমাজের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শবেবরাত নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি ও ধর্মীয় নির্দেশনার পরিপন্থি কোনো প্রথার সংযোজন যেমন প্রত্যাশিত নয়; পক্ষান্তরে এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা, আবহমানকাল থেকে পালন করে আসা ধর্মীয় রীতি-পদ্ধতির বিরোধিতা করা ও ব্যাপক মুসলিম জনগোষ্ঠীর হৃদয়-মানসে পরম ভক্তির সঙ্গে গ্রথিত থাকা এই শবেবরাতকে অবজ্ঞা করা ও ছুড়ে ফেলা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এ ধরনের মানসিকতা হীনমন্যতার পরিচায়ক ও মুসলিম ঐক্য-সংহতির খেলাফ বিধায় তা সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। শবেবরাতের অস্তিত্ব, মাহাত্ম্য, ঐতিহাসিক ভিত্তি ও এর আচার-অনুষ্ঠানের পালন-বর্জন নিয়ে উম্মতে মুসলিমাহ্র মাঝে অহেতুক সৃষ্ট বিভাজন ও বিভ্রান্তি এক ভয়াবহ সামাজিক ফেতনার শামিল। আর কোরআনুল কারিমে ফেতনাকে ভয়ানক বিপর্যয়, যা কি-না হত্যার চেয়েও মারাত্মক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সিয়ামব্রত পালনের পবিত্র মাস রমজানের প্রাক্কালে মহান প্রভুর কাছে মিনতি করে বলতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর রজব ও শাবানের বরকত দান করো এবং আমাদের মাহে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। মহানবীর (সা.) উল্লিখিত প্রার্থনাবাণীতে শাবান মাসে যে বরকত নিহিত, তা পরিস্টম্ফুট। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আমরা শাবানের সেই বরকতময় অবস্থার ইঙ্গিত পাই। সুরা দুখানের তিন থেকে পাঁচ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে কোরআন অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চিতভাবে আমিই ভয় প্রদর্শনকারী। এ রাতে আমার পক্ষ হতে আমারই নির্দেশে সব প্রজ্ঞাময় কর্মের ফয়সালা হয়ে থাকে। আর অবশ্যই আমি সবকিছুর প্রেরণকারী।’
পবিত্র কোরআনের বিশ্নেষক ও ধর্মীয় প্রাজ্ঞজনের একটি বড় অংশের মতে, কোরআনে কারিমে উল্লিখিত ‘বরকতময় রাত’ বলতে আরবি অষ্টম মাস শাবানের মধ্য রজনী তথা শবেবরাতকেই বোঝানো হয়েছে। মানুষের ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, লাভ-ক্ষতি, সম্মান-অসম্মান, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিসহ সবকিছুই আয়াতে উল্লিখিত ‘সব প্রজ্ঞাময় কর্মের ফয়সালা’র অন্তর্ভুক্ত, যা লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান তথা শাবানের মধ্যরাতে সম্পন্ন হয় বলে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে বিশ্নেষকরা মত ব্যক্ত করেছেন। সে কারণে এই রাতকে শবেবরাত বা ভাগ্য-রজনী হিসেবেও দেখা হয়। পবিত্র শাবান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদার পেছনেও শবেবরাতের মহিমা ও তাৎপর্য অপরিসীম।
ইতিহাসের স্বতঃসিদ্ধ তথ্য হচ্ছে, মহানবীর (সা.) পূর্বেকার সব নবী-রাসুলের উম্মতরা দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন। ফলে বহুদিন পর্যন্ত নেক আমল তথা ভালো কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ তারা অর্জন করেন। কিন্তু আখেরি জমানার পয়গম্বর মুহাম্মদের (সা.) উম্মতের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের আয়ুস্কাল পূর্ববর্তীদের তুলনায় খুবই সীমিত। এই স্বল্পায়ু উম্মতের অধিকতর পুণ্য অর্জনের জন্য যেসব দিবস ও রজনী মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উপঢৌকন হিসেবে এসেছে; পবিত্র শবেবরাত তারই অন্যতম উপলক্ষ; যে রাতে বন্দেগি-উপাসনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
অনন্য মহিমা আর অনবদ্য বৈশিষ্ট্যে মোড়ানো এই পবিত্র শবেবরাত। এ রাত দোয়া-প্রার্থনা কবুলের রাত। এ রাত পাপাচার থেকে মুক্তি অর্জনের রাত। এ রাত বান্দার তওবা-অনুশোচনা মঞ্জুর হওয়ার রাত। এ রাত যাবতীয় বালা-মুসিবত তথা বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধারের রাত এবং এ রাত প্রতিটি মানুষের আগামী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণের গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। রজব মাসের প্রথম রাত, দুই পদের রাত এবং শবেকদরের রাতসহ বান্দার দোয়া কবুল হয় যে পাঁচটি পবিত্র রাতে, তার অন্যতম হলো এই শবেবরাত। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, শবেবরাতের জন্য মহানবীর (সা.) নির্দেশনা হলো, দিবসে সিয়ামব্রত পালন আর রাতে আল্লাহর ইবাদত করা। কেননা, এ রাতে মহান আল্লাহর এক অপূর্ব রহমতের বারিধারা বর্ষিত হয়। দুনিয়ার একেবারে কাছাকাছি এসে মহান বিশ্বনিয়ন্তা ঘোষণা করতে থাকেন- কে আছ গুনাহগার, আমি তোমার সব অপরাধ মার্জনা করে দেব। কে আছ অন্নপ্রার্থী, আমি তোমার রিজ্কের ব্যবস্থা করে দেব। কে আছ বিপদগ্রস্ত, আমি তোমাকে বিপদমুক্ত করব। এভাবেই পূর্ব দিগন্তে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সাফল্য ও মুক্তিলাভের ঘোষণা অব্যাহত থাকে।
শবেবরাতে অসংখ্য ফেরেশতার পৃথিবীতে অবতরণ, ইবাদতকারীদের পর্যবেক্ষণ, শান্তির সুবাতাস প্রবাহিতকরণ এবং বিশেষ এ রাতকে জীবন্ত রাখার ব্যাপারে মহানবীর (সা.) নির্দেশনা শবেবরাতকে এক অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছে। এ রাতের ব্যাপারে নবীপত্নী হজরত আয়েশা সিদ্দিকার দেওয়া তথ্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, আমি রাসুলে পাকসহ একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন আমার ঘুম ভাঙল, দেখি রাসুল আমার পাশে নেই। খুঁজতে গিয়ে তাঁকে জান্নাতুল বাকিস্ফ কবরস্থানে পেলাম। আমি শুনতে পাচ্ছি নবীজি বলছেন, শবেবরাতে মহান আল্লাহ সর্বনিম্ন আকাশে নেমে আসেন এবং আরবের কাল্ব উপজাতির ছাগলের পশমতুল্য বা তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য মওকুফ করে দেন। উল্লেখ্য, এ সম্প্রদায়ের অজস্র ছাগল ছিল, যাদের পশম সংখ্যা অগণিত।
বস্তুত আল্লাহর বান্দাদের কাছে প্রতিটি রাতই ইবাদতের এবং প্রতিটি ক্ষণই মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ। আবহমানকাল থেকে চলে আসা এসব বিশেষ ও পবিত্র দিবস ও রজনী আজ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে শবেবরাতে রাতভর ইবাদতে মশগুল থাকা, রাত্রী জাগরণ ও বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা- এসবই এখন আমাদের উৎসব এবং উপভোগের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। খোদাভীরুতা, ইস্তেগফার, দোয়া-প্রার্থনা, জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত, কবর জিয়ারত, আত্মীয়ের সান্নিধ্য- এসবের কোনোটাই নেতিবাচক কাজ নয়; বরং ব্যস্ত দিনপঞ্জি আর পার্থিব কোলাহলের মাঝে বিশেষ উপলক্ষে এসব মানবিক, ধর্মীয় ও মূল্যবোধগত কর্ম সম্পন্নকরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের মানসিকতা আরও ইতিবাচক করে তোলার এক চমৎকার সুযোগ অর্জিত হয়। তাই শবেবরাত নিয়ে কোনো ধরনের এখতেলাফ বা মতদ্বৈধতা-মতপার্থক্য সৃষ্টি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় এবং এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে সাধারণ মানুষকে এ রাতের ইবাদত থেকে নিরুৎসাহিত করার মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকার কথা নয়। পাশাপাশি এ রাতকে ঘিরে কারও বাড়াবাড়ি করা, আতশবাজি, পটকা ফোটানোসহ জনজীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে এমন কিছু করাও সঙ্গত বা প্রত্যাশিত নয়। বরং ইসলাম ও এর শরিয়তের গণ্ডির ভেতরে থেকেই পুণ্য অর্জনের ব্রত নিয়ে মহিমান্বিত রজনী শবেবরাতের প্রকৃত কল্যাণ হাসিল করা বাঞ্ছনীয় এবং উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িকতার মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মানবজীবনে এ বিশেষ রাতের বরকত ও মহিমা কাজে লাগানোই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়