শিক্ষক নিয়োগে অচলাবস্থা

image-221657-1613069425

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সুলতানা পারভীন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ১২তম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সরিষাবাড়ী উপজেলায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট উপজেলার একটি কলেজে নিয়োগ পাবার কথা তার। কিন্তু ৫ বছরেও তিনি মেধা তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ পাননি।

শুধু সুলতানা পারভীন নয়, এভাবে অনেক মেধাবী চাকরিপ্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। এভাবে বঞ্চিত হয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। এতে আবার আটকে গেছে সকলের নিয়োগও। তবে সব প্রার্থীর একই বক্তব্য, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণেই এমনটি হয়েছে। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের।

এনটিআরসিএর এই অব্যবস্থাপনার কারণে ঝুলে গেছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। দুই বছর ধরে বন্ধ নিয়োগ প্রক্রিয়া। অথচ এই সময়ে অবসরে গেছেন অনেক শিক্ষক। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই সংখ্যা ১ লাখের কাছাকাছি হবেন। আর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরও নিয়োগ না পাওয়ায় হতাশায় ভুগছেন তরুণ প্রার্থীরা।

২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য সনদ দিত এনটিআরসিএ। এই সনদ থাকলেও নিয়োগের ক্ষমতা ছিল গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির হাতে। ২০১৫ সালে এই পদ্ধতির পরিবর্তন আনে সরকার। ১২তম নিবন্ধন পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে মেধা তালিকা করা হয় উপজেলা ভিত্তিক। শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার আগে পাশ হয় নতুন আইনও। কিন্তু মেধা তালিকা করলেও এদের নিয়োগ দেয়নি এনটিআরসিএর তত্কালীন চেয়ারম্যান।

মূল্যায়নে অসঙ্গতি:

এনটিআরসিএ ১ম থেকে ১১ তম নিবন্ধন পরীক্ষার্থীদের একই দিন ১০০ নম্বরের এমসিকিউ ও ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করে। প্রাপ্ত নম্বর গড় করে নম্বর দিয়ে সনদ দেওয়া হয়। ১২তম নিবন্ধন পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষায় শুধু পাশ দেওয়া হয়। আর ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর দিয়ে ফল প্রকাশ করা হয়। তাদের কোনো মৌখিক পরীক্ষা হয়নি।

১৩তম নিবন্ধন পরীক্ষায় থেকে আবারও পরিবর্তন আনা হয়। ১০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষায় শুধু পাশ দেখানো হয়। ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা ও ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সনদে মৌখিক পরীক্ষার নম্বরও জুড়ে দেওয়া হয়।

পরীক্ষার নম্বরে ও মূল্যায়নে এমন অসঙ্গতিতে অনেক শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন। এ বিষয়ে এনটিআরসিএতে অভিযোগের স্তূপ জমা পড়েছে। সুলতানা পারভীন নামে এক প্রার্থী তার দেওয়া অভিযোগে বলেন, মূল্যায়নের অসঙ্গতির কারণে তিনি মেধা তালিকা থেকে পিছিয়ে পড়েছেন। তাই ১২তম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধা তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি তুলেছেন তিনি।

তবে এনটিআরসিএ সদস্য (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) এ বি এম শওকত ইকবাল শাহীন বলেন, এভাবে নম্বরে পার্থক্য হলেও প্রার্থীদের বঞ্চিত হবার কোনো সুযোগ নেই। শুধু লিখিত পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতেই সমন্বিত বিষয়ভিত্তিক মেধা তালিকা করা হয়েছে। তবে ১৩তম থেকে কেন মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হলো এবং কেনই বা নম্বর দেওয়া হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর আগে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যারা কথা বলতে পারেন না। মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে তারা কথা বলতে পারে কি না এবং বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা আছে কি না, তা দেখার জন্য।

এনটিআরসিএ ১ম থেকে ১৪তম সমন্বিত মেধাতালিকা থেকে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রায় ৪০ হাজার পদে নিয়োগ দেয়। নিয়োগের পর একাধিক মামলা হয়। বর্তমানে আদালতের রায়ে প্রথম থেকে ১৫তম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে একটি সম্মিলিত মেধা তালিকা তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আবার প্রার্থী কমানোর জন্য প্রথম থেকে ৩য়, প্রথম থেকে ৬ষ্ঠ বা প্রথম থেকে ৮ম নিবন্ধন পর্যন্ত বাদ দেওয়ার গুঞ্জন ওঠে। এসব কারণে ৪০০-এর বেশি রিট মামলা করেন প্রার্থীরা।

শান্ত আলী নামে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক প্রার্থী বলেন, দ্রুত গণবিজ্ঞপ্তি জারির অপেক্ষা করছি। কয়েক লাখ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়ে বসে আছেন। হতাশার মধ্যে রয়েছেন।

আমিরুল ইসলাম নামে এক প্রার্থী বলেন, আগে টাকার বিনিময়ে অনেকে সনদ পেয়েছেন। বিভিন্ন সময় যাচাইয়েও সেগুলো প্রমাণিত হয়েছে। এমন অনেক প্রার্থী দেখা গেছে, যারা লিখিত পরীক্ষা ১০০ এর মধ্যে ৯৫ পেয়েছেন। এটা কীভাবে সম্ভব। জালিয়াতির মাধ্যমে যারা নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সমন্বিত মেধা তালিকা থেকে তাদের বাদ দিতে হবে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১ম থেকে ১৫তম নিবন্ধন পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ৬ লাখ ৩৪ হাজার ১২৭ জন রয়েছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৮২১ জনের বয়স ৩৫ বছর পার হওয়ায় তারা নিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার অনেকে বিভিন্ন চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। গণবিজ্ঞপ্তির জন্য গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৩৬০টি শূন্য পদের তালিকা দিয়েছিল শিক্ষা বিভাগ। এখন পর্যন্ত নতুন করে আরো ৩০ হাজারের বেশি শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রার্থীরা অপেক্ষা করছেন। গত জানুয়ারি মাসে ৩য় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা হয়নি।

কেন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে দেরি হচ্ছে—এ বিষয়ে এনটিআরসিএ জানিয়েছে, সমন্বিত মেধা তালিকার বিরুদ্ধেও উচ্চ আদালতে রিট মামলা হয়েছে। আমরা রিভিউর জন্য অপেক্ষা করছি। আশা করি, এ বিষয়ে দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে এবং তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।

Pin It