আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গত এক বছরে কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিসংখ্যান সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। তবে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি বিশেষত শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বেকারত্ব দূর করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় উন্নতি দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফল এমনটাই বলেছে। অন্যদিকে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিও কমেছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের অঙ্গীকার ছিল। ‘তারুণ্যের শক্তি- বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ শিরোনামে ইশতেহারে তরুণ ও যুব সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির অঙ্গীকার রয়েছে। এ হিসাবে বছরে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা। কিন্তু ২০১৯ সালে কত কর্মসংস্থান হয়েছে তার পরিসংখ্যান নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ করে ২০১৬ সালে। ওই জরিপ অনুযায়ী কর্মক্ষম জনশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। বেকার মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। গত ১৩ জুন ২০১৯-২০ সালের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি চাকরি সৃষ্টির ঘোষণা দেন। তিনি জানিয়েছিলেন, বছরে ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হন। দেশে-বিদেশে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তবে কোন খাতে কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তার উল্লেখ নেই। এদিকে ২০১৯-২০ সালের বাজেটে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে ‘স্টার্টআপ’ নামে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। চলতি অর্থবছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এর কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
গবেষণা কী বলে :দেশে কর্মসংস্থান পরিস্থিতির ওপর হালনাগাদ তথ্য না থাকলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা শিক্ষিত শ্রেণির বেকারত্ব নিয়ে একটি ধারণা দিয়েছে। ‘বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব’ শিরোনামের ওই গবেষণার ফল গত মাসে বিআইডিএসের দুই দিনব্যাপী গবেষণা সম্মেলনের একটি অধিবেশনে উপস্থাপন করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস, এমন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের তিন ভাগের এক ভাগ বেকার। তারা কোনো কাজ করেন না বা পড়াশোনাও করেন না। শিক্ষিতদের মধ্যে সার্বিকভাবে ৪৮ শতাংশ পূর্ণকালীন কাজ করেন।
১৮ শতাংশের মতো খ কালীন কাজে নিয়োজিত। আর ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ পূর্ণ বেকার। সবচেয়ে বেকার স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে। প্রায় ৩৭ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ৩৪ শতাংশের বেশি বেকার। এসএসসি পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার যথাক্রমে ২৭ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করাদের ক্ষেত্রে এ হার ২৮ শতাংশ। গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ। গবেষকরা দেশের ছয় লাখ ১৮ হাজার ২৬২ তরুণ-তরুণীকে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে গবেষণার প্রশ্ন পাঠান। এর মধ্যে ১৫ হাজার ২৫ জন উত্তর দেন। তাদের উত্তরের ভিত্তিতে গবেষণার ফল তৈরি হয়। তারা সবাই স্নাতকোত্তর, স্নাতক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পাস।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপে (২০১৬-১৭) শিক্ষিত শ্রেণির বেকারত্বের যে পরিসংখ্যান ছিল, এই গবেষণার ফলে তার চেয়ে খারাপ অবস্থা পাওয়া গেছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ১১ দশমিক ২ শতাংশ। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এ হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দুই কারণে কর্মসংস্থান পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। প্রধান কারণ, বছরে যত মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে তত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও তার বিপরীতে দক্ষ কর্মী নেই। শিক্ষার নিম্নমানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরাও দক্ষ নন। তারা চাকরি পেলেও পছন্দ অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না। তাই বেকারদের বড় একটি অংশ চাকরি অনুসন্ধানকারী। দেশীয় কর্মসংস্থানের মাত্র পাঁচ শতাংশ পূরণ হয় সরকারি চাকরিতে। কিন্তু তরুণ চাকরি প্রার্থীদের বড় অংশই সরকারি চাকরির দৌড়ে রয়েছেন। বছরের পর বছর এর জন্য প্রস্তুতি নেন।
বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. রুশিদান ইসলাম রহমান মনে করেন, কর্মসংস্থান ও বেকারত্বের হালনাগাদ পরিসংখ্যান নেই। তাই প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ করা কঠিন। কিন্তু এক বছরে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। বেকারত্ব যেমন ছিল, তেমনই আছে। কর্মসংস্থান খুব একটা বাড়েনি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতির কতটা পূরণ হয়েছে- এমন প্রশ্নে দলটির শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে কর্মসংস্থান করবেন তিনি। এর অর্থ এই নয় যে, প্রতিটি ঘরে একটি করে চাকরি দেওয়া হবে। বরং যারা বেকার ও কর্মহীন রয়েছেন, তারা কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেরা কাজ করার পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করবেন- সরকারের প্রতিশ্রুতিতে সেটি ছিল। সরকারের এক বছরে এ ক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রগতি আছে।
প্রবাসে কর্মসংস্থান কমেছে :২০১৭ সালে রেকর্ড সংখ্যক ১০ লাখ আট হাজার বাংলাদেশি কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশ যান। ২০১৮ সালে তা ২৭ শতাংশ কমে সাত লাখ ৩৪ হাজারে দাঁড়ায়। গত বছর জনশক্তি রপ্তানি আরও কমেছে। ২০১৯ সালে মোট সাত লাখ এক হাজার কর্মী বিদেশ গেছেন। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ চার লাখ গেছেন সৌদি আরবে। জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে দেড় বছর ধরে। আরব আমিরাতের শ্রমবাজারও বন্ধ কয়েক বছর ধরে। এ কারণেই জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। গত বছর বাংলাদেশি কর্মীদের ৯০ শতাংশের গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য। এর বাইরে ৫০ হাজার কর্মী সিঙ্গাপুর গেছেন।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, জাপানের শ্রমবাজার খুলেছে। পূর্ব আফ্রিকার দেশ সেশেলসের বাজার আবার উন্মুক্ত হয়েছে। ইউরোপের শ্রমবাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে বাংলাদেশে। এসব বাজারে মধ্যপ্রাচ্যের মতো লাখ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হবে না। কিন্তু যতজনই যাবেন, তারা ভালো থাকবেন। ভালো উপার্জন করবেন।