শুধু রাজনীতিকই নন, আখতারুজ্জামান বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রিয় বাবু ভাই।
নানা ঝড়ঝাপ্টার মাঝেও দলীয় আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল, দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বড় অবলম্বন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। দীর্ঘ সময় ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও ছিলেন তিনি। জাতীয় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার।
নবম জাতীয় সংসদে ছিলেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন।
১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার বাবার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী ও জমিদার। তার মায়ের নাম খোরশেদা বেগম। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে একই বছর ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন।
ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে নিউইয়র্ক ইউনিভর্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। ওখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন। ১৯৬৫ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউজ থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান।
১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসাবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ’৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তী সময়ে দলের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু কেবল রাজনীতিকই ছিলেন না, তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে তিনি বড় ভাইয়ের কারখানাগুলোও দেখাশোনা করতেন। পরবর্তী সময়ে আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিথেটিক প্রডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দুদশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসাবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুদফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮৮ সালে। তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি এ মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সমাজহিতৈষী, দানবীর ও জনদরদি ছিলেন। ’৬৭ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরও হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ার বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি। আনোয়ারা ডিগ্রি কলেজ, হাইলধর বশরুজ্জামান স্মৃতি শিক্ষা কেন্দ্র, বরুমছড়া শহীদ বশরুজ্জামান উচ্চবিদ্যালয়, আনোয়ারা যোগেশ চন্দ্র মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ঝি.বা.শি উচ্চবিদ্যালয়সহ অনেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।
আমি সৌভাগ্যবান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো এত বড় মাপের মহৎ হৃদয় জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ হয়েছে। বিশ্বস্ততার সঙ্গে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার অভিভাবকত্বে রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি, মিশেছি। সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়েছি। দেখেছি তার নরম প্রকৃতির হৃদয়, মানুষকে ভালোবাসার উদার মন-মানসিকতা। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্র সৈনিক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর সেই সব বিরল রাজনীতিকের অন্যতম; যারা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে হাল ধরেছেন, রাজনীতি করেছেন নিজেদের অর্থ ব্যয় করে।
একজন মানুষের সঙ্গে চলে যায় গোটা একটি পৃথিবী। কথাটি লিখেছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আসলে সব মানুষই জীবনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে গড়ে তোলেন আপন ভুবন। কর্মে, কীর্তিতে, মেধায়, মননে, স্নেহ-ভালোবাসায় অনন্য স্বাক্ষর রেখে যান। তারা সারা জীবন ধরে তৈরি করেন একেকটি বিচিত্র ও বর্ণিল পৃথিবী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন এমনই এক অসাধারণ মানুষ। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সংগঠন ও জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।
সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসাবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর জীবনী থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। জীবনে অনেকবার মন্ত্রিত্বের সুযোগ পেয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারক ছিলেন। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। তিনি ছিলেন একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিতে যেমন, তেমনই ব্যবসা, ব্যাংক, বিমা ও শিল্প স্থাপনে ছিলেন একজন ঈষর্ণীয় সফল ব্যক্তিত্ব।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার অবদান অপরিসীম। যে কোনো কঠিন সময়ে দলের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত এক কর্মী। ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একজন অভিভাবক। তার মৃত্যু চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগকে শুধু অভিভাবকহীন করেনি, সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এ শূন্যতা পূরণ হবে না কোনোদিন। তবে তার দেখানো পথে আমরা যেভাবে এগিয়ে চলেছি, আমাদের বিশ্বাস-তরুণ প্রজন্ম সেভাবে এগিয়ে গেলে এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।