নতুন বছরে পুরনো সব জীর্ণতা মুছে যাবে- এই প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশ এখন বঙ্গাব্দ ১৪২৬ এর নতুন সূর্যের অপেক্ষায়।
যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আগুনে ঝলসে প্রাণ হারানো নুসরাতের জন্য যখন ক্ষোভে ফুঁসছে দেশ, সে সময় এই বর্ষবরণের কর্মসূচিতে আসছে সব সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে শুভবোধের জাগরণের আহ্বান।
এই আহ্বানকে কেন্দ্র করে পহেলা বৈশাখের সব আয়োজন সাজিয়েছে ছায়ানট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যেও রয়েছে অশুভকে বিনাশ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা।
রোববার ভোর তাই বাঙালির জীবনে আসছে নতুন বারতা নিয়ে।বাঙালির সার্বজনীন এই উৎসবের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে শনিবার চৈত্র সংক্রান্তির নানা আয়োজনে ১৪২৫ বঙ্গাব্দকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে।
চৈত্রের শেষ দিনে হালখাতা করে ব্যবসার হিসাব চুকানো বাংলার পুরনো রেওয়াজ। আর রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বাণীতে কণ্ঠ মিলিয়ে বৈশাখের প্রথম দিন বাঙালির প্রত্যাশা থাকে; বৈশাখের রুদ্র ঝড় পুরনো বছরের আবর্জনা উড়িয়ে নেবে; গ্রীষ্মের অগ্নিস্নানে সূচি হবে বিশ্ব ধরা।
আর্থ-সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও সাম্প্রদায়িকত সহিংসতা, সামাজিক বৈষম্য-অনাচার এখনও বড় সমস্যা। গেল সপ্তাহেই মারা গেছেন ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি, নিজের প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ওই ঘটনায় দেশজুড়ে নারী-শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ চলতে থাকলেও এরমধ্যেই প্রতিদিনই ধর্ষণ-নিপীড়নের খবর আসছে।
এই প্রেক্ষাপটে দল-মত, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মানব মুক্তির ডাক ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক ও শেকড় সন্ধানী অবিনাশী চেতনার কথা সমাজের তৃণমূলে নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
আর নতুন বছরের প্রথম দিনে অতীতের গ্লানি ভুলে জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে দুই দশক আগে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে সাম্প্রদায়িক হামলার পর থেকে পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে রাখে নিরাপত্তা বাহিনী।
ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে পহেলা বৈশাখের উন্মুক্ত আয়োজন সব শেষ করে ফেলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সময়সীমা বেঁধে দেয় প্রতি বছর, তার নিন্দা করে চলেছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
এ বছরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, পথনাটক পরিষদ, উদীচীসহ নয়টি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে।
তারা বলেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’।
শনিবার ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের আয়োজনের প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, এবারের আয়োজনকে ঘিরে তিনি কোনো ‘শঙ্কা দেখছেন না’।
উৎসবের দিন
ছায়ানট এবার বৈশাখ বরণ করছে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে শুভবোধের জাগরণের আহ্বানে।
পহেলা বৈশাখে ভোর সোয়া ৬টায় বছরের প্রথম সূর্যোদয়কে ছায়ানট স্বাগত জানাবে রাগালাপ দিয়ে।
তাদের প্রভাতী আয়োজনের প্রত্যূষে থাকছে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও সৃষ্টির মাহাত্ম্য নিয়ে ভোরের সুরে বাঁধা গানের গুচ্ছ। পরের ভাগে থাকছে অনাচারকে প্রতিহত করা এবং অশুভকে জয় করার জাগরণী সুরবাণী, গান-পাঠ-আবৃত্তিতে দেশ-মানুষ-মনুষ্যত্বকে ভালোবাসার প্রত্যয়।
শিক্ষার্থী-প্রাক্তনী-শিক্ষক নিয়ে ছোট বড় মিলিয়ে এবারের অনুষ্ঠানে সম্মেলক গান পরিবেশন করবেন শখানেক শিল্পী।
অনুষ্ঠানে থাকছে ১৩টি একক ও ১৩টি সম্মেলক গান এবং দুটি আবৃত্তি। ছায়ানটের আহ্বান অনুযায়ী রবীন্দ্র রচনা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে আবৃত্তি দুটি।
গানগুলো নির্বাচন করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ্, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ্ আবদুল করিম, কুটি মনসুর, সলিল চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে।
জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানার আগে ছায়ানট সভাপতি শুভবোধ জাগরণের আহ্বান জানাবেন তার কথনে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলতে থাকায় এ বছর বদলে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রার পথ।
রোববার সকাল ৯টায় অনুষদের সামনে থেকে বের হয়ে শাহবাগ মোড়, ঢাকা ক্লাব ঘুরে মঙ্গল শোভাযাত্রা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। পরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে শেষ হবে শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রার পুরোভাগে থাকবে মহিষ, পাখি ও ছানা, হাতি, মাছ ও বক, জাল ও জেলে, টেপাপুতুল, মা ও শিশু এবং গরুর শিল্পকাঠামো।
চারুকলা অনুষদ এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য করেছে ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’।
চারুকলার ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সমন্বয়ক তন্ময় দেবনাথ বলেন, “সব জরাজীর্ণতা ভুলে, ভুল-ভ্রান্তি সব সংশোধন করে আমরা যেন এবার মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারি, সে লক্ষ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে এবারের প্রতিপাদ্য।”
২০১৬ সালে ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ- এর মর্যাদা পায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরের বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ঢাকার বাইরে সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ বছরও তারা প্রতিটি জেলা, উপজেলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা ও নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজনের নির্দেশনা দিয়েছে।
নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজন রয়েছে বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমিতেও।
বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র-চত্বরে সকাল ৮টায় শুরু হবে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা।
এ বছর নববর্ষ-বক্তৃতা প্রদান করবেন প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একাডেমি প্রকাশিত বই নিয়ে থাকছে বইয়ের আড়ং। পহেলা বৈশাখ থেকে মেলা চলবে ১০ বৈশাখ পর্যন্ত।
নববর্ষ কেবল আনুষ্ঠানিকতানির্ভর কোনো উৎসব নয়: রাষ্ট্রপতি
বাংলা নববর্ষ উৎসবকে কেবল আনুষ্ঠানিকতানির্ভর কোনো উৎসব মনে করেন না রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
তার মতে, “বরং তা বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শেকড় সন্ধানের অবিনাশী চেতনাবাহী দিন।”
জাতির উদ্দেশে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, “বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ উৎসব সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয় এবং জাতিসত্তা বিকাশের শেকড়।”
প্রতি বছর ‘সার্বজনীন উৎসব’ পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা বিকাশের প্রবল শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয় বলে বাণীতে উল্লেখ করেছেন তিনি।
আবদুল হামিদ বলেন, “এখানে ধর্ম-বর্ণ-দল-মতের কোনো বিভেদ নেই। তাইতো এই উৎসবটি বাঙালির জীবনাচার, চিন্তা-চেতনা, বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে একাকার হয়ে মিশে আছে আবহমান কাল থেকে। বাংলা নববর্ষের এই বর্ণিল উদযাপন মানুষের মাঝে অনাবিল আনন্দ, উৎসাহ-উদ্দীপনা আর সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আসে।”
হাজার বছরের সাংস্কৃতিক চেতনায় ঋদ্ধ বাংলাদেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস বা সাম্প্রদায়িকতার ‘কোনো স্থান নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির আশা, “পারস্পরিক সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি যে জাতির চিরকালীন ঐতিহ্য তা কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না। বাংলা নববর্ষের চেতনা অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে প্রেরণা এবং শক্তি হিসেবে কাজ করবে।”
নতুন আশায় বুক বাঁধি : প্রধানমন্ত্রী
নববর্ষ উদযাপনের দিনে অতীতের গ্লানি ভুলে নতুন আশা নিয়ে সামনে এগোনোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বাণীতে তিনি বলেন, “নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা অতীতের গ্লানি ভুলে জীবনের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে আশায় বুক বাঁধি। দেনা-পাওনা চুকিয়ে নতুন করে শুরু হয় জীবনের জয়গান।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পহেলা বৈশাখ তাই যুগ যুগ ধরে বাঙালির মননে-মানসে শুধু বিনোদনের উৎস নয়, বৈষয়িক বিষয়েরও আধার।”
শেখ হাসিনা মনে করেন, বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরস্পর ‘সম্পর্কযুক্ত’।
তিনি বলেন, “বাঙালি জনগোষ্ঠী বর্ষবরণ উৎসবকে ধারণ করেছে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে।”
নতুন বছরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।