বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে রাজনীতিতে নেমেছিলেন গণমানুষের পাশে থাকতে, বন্ধুর সেই পথে নিজের আদর্শে অটুট থাকা বরেণ্য সেই রাজনীতিক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শেষ বিদায় জানাল সবাই।
সবার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শনিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফরকে।
৯৭ বছর বয়সে আগের দিনই মৃত্যু হয়েছিল প্রবীণ এই রাজনীতিকের, যে মৃত্যুকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারায় ‘একটি যুগের অবসান’ বলছেন অনেক রাজনীতিক।
শনিবার সকালে প্রথমে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে জানাজা হয় সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোজাফফরের; সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোও হয়। পরে মরদেহ নেওয়া হয় ধানমণ্ডিতে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
সেখান থেকে দুপুরে কফিন নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে; রাজনৈতিক সহকর্মী, অনুসারীদের ফুলে ফুলে ঢেকে যায় এই রাজনীতিকের কফিন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভেদের রেখা থাকলেও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পাকিস্তানের আইনসভায় প্রথম উত্থাপনকারী মোজাফফরের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে মুছে গিয়েছিলে সেই রেখা।
আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও শেষ বিদায় জানায় প্রয়াত নেতাকে।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু শ্রদ্ধা জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন একজন জাতীয় নেতা। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন।
“বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন এবং প্রগতিশীল রাজনীতিতে তার অবদান অনেক। তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। এজন্যই তিনি জাতীয় নেতা।”
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “অধ্যাপক মোজাফফর সমাজতন্ত্রের জন্য আত্মনিয়োজিত একজন নেতা ছিলেন। তিনি ন্যাপ নেতা ছিলেন বটে, কিন্তু রাজনীতির শুরুতে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিরও একজন সদস্য ছিলেন।”
দেশ স্বাধীন করতে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা মোজাফফর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনেও ভূমিকা পালন করেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করা মোজাফফর আহমদ; ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারও তিনি নেননি।
সংসদ ভবনে জানাজার পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, “রাজনীতিতে কীভাবে আত্মোৎসর্গ করতে হয়, কীভাবে সততার দৃষ্টান্ত রাখতে হয়, লোভ-লালসা পরিহার করতে হয়, অনন্তকাল তার অনুপ্রেরণা জোগাবেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।”
শ্রদ্ধা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, “অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জীবনে কোনো সম্মাননার পেছনে ছোটেননি। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, শুধু পদ-পদবির পেছনে ছোটাই রাজনীতি না। আদর্শের রাজনীতিই হল প্রকৃত রাজনীতি।”
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্ষেত্রে অধ্যাপক মোজাফফর অনন্য অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকবে।”
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু বলেন, “উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হল।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের শিক্ষক মোজাফফরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন কিংবদন্তি ছিলেন তিনি।
“বাংলাদেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তার অবদান কোনো না কোনোভাবে আছে। তার লোভ-লালসাহীন রাজনীতি আগামী দিনের রাজনীতিবিদদের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে পর বায়তুল মোকাররমে জানাজা হয় অধ্যাপক মোজাফফরের।
ন্যাপ নেতারা জানিয়েছেন, রোববার কুমিল্লার দেবিদ্বারে পারিবারিক কবরস্থানে শেষ শয্যা নেবেন এই রাজনীতিক।
জিজিএনটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।