নতুন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়ার দিনে কলম্বোয় বিক্ষোভকারীদের ওপর বর্বর অভিযান চালিয়েছে শ্রীলংকার সেনা-পুলিশ ও স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ)।
বিক্ষোভকারীরা যেসব তাঁবুতে থাকতেন সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ১২ ঘণ্টার মধ্যে এই ‘হামলা’ চালালেন তিনি। সাদা চোখে অকস্মাৎ এ অভিযানের বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় দমন-পীড়নের নতুন যুগে প্রবেশ করেছে ক্ষুধায় কাতর দ্বীপরাষ্ট্রের জনগণ।
রনিল তার কথা রেখেছেন। শপথ নেওয়ার পরপরই বলেছিলেন, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা কিংবা সরকারি ভবন দখল নেওয়া কোনো গণতান্ত্রিক কার্যক্রম নয়। এই ধরনের কোনো কিছু করা হলে কঠোরভাবে দমন করা হবে। করলেনও তাই।
শুক্রবার রাত ১২টায় (স্থানীয় সময়) সশস্ত্র সৈন্যরা গল ফেস বিক্ষোভ ময়দানের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। এ সময় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী এবং সাংবাদিকদের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনারা। গল ফেসের চারপাশে তখন প্রায় ২০০০ সেনা। তবে কারও চেহারা দেখতে পারেনি বিক্ষোভকারী বা উপস্থিত সাংবাদিকরা। মুখ বাঁধা ছিল সবার।
হামলাটি এমন সময় ঘটল যখন বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে আগে দখলে নেওয়া প্রেসিডেন্ট সচিবালয় থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আগের দিনই বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
১২টা বাজার ঠিক কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় দুই হাজার সদস্যের বিশেষ বাহিনী যেখানে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীসহ পুলিশের বিশেষ ফোর্স গল ফেসের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয় এবং রুদ্ধদ্বার অভিযান পরিচালনা করে।
আমি তখন গল ফেস থেকে ১২ কিমি. দূরের পেপিলিয়ানাতে আমার বাড়িতে। লাইভে দেখছি, হাহাকার শুনছি আর ভেতরে ছটফট করছিলাম, কখন যাব? কীভাবে যাব সেখানে? কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য গাড়িতে জ্বালানি ছিল না। যেতে পারলাম না! সাক্ষী হতে পারলাম না শ্রীলংকার এই কালরাতের! ঘরে বসেই যোগাযোগ শুরু করলাম পরিচিত বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে, সাংবাদিকদের সঙ্গে। আমার এক সাংবাদিক সহকর্মীর কাছে খবর পেলাম শ্রীলংকা জেগে ওঠার অনেক আগেই গল ফেস ফাঁকা করে দিয়েছে রনিলের সেনারা। ঘুম থেকে উঠে আমি যখন এ প্রতিবেদন লিখছি তখন সেখানে আর বিক্ষোভকারী নেই! শত শত সেনা-পুলিশ। বুট-বন্দুকের তোড়জোড়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা রাতেই আমাকে বলছিলেন, এসটিএফ কর্মীরা মুখোশ পরা ছিল। তারা লোহার রড দিয়ে বিক্ষোভকারীদের নির্মমভাবে পেটায়। আপত্তিকর ভাষায় গালাগাল করতে থাকে। অসহায় বিক্ষোভকারীরা অনেকেই লাইভ ফুটেজে সেনাবাহিনীর ‘বীভৎসতা’ তুলে ধরেন। উদ্দেশ্য, দেশবাসী জানুক কী ঘটছে তাদের শেষ ভরসাস্থলে। ফুটেজে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের একজন মেলানি গুনাথিলাকা বলেন, ‘গত রাতে আমরা একটি বৈঠক করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আজ প্রেসিডেন্ট সচিবালয় ফিরিয়ে দেব।’
বৈঠক শেষ করেই রওয়ানা হই বাড়ির পথে। দুদিন পর বাড়িতে ফিরলাম। ঘরে ঢুকতেই মেসেজ পাই কলোম্বোতে ঝড় তুলেছে সশস্ত্র বাহিনী। ঘিরে ফেলেছে আমাদের গল ফেস। আমি গলেতে ফিরে আসার আগেই সশস্ত্র বাহিনী হামলা চালিয়েছে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও অহিংস আন্দোলনরত কর্মীদের ওপর। বর্তমানে আমরা গল ফেসের বিক্ষোভস্থল থেকে প্রায় ১.২ কিমি. দূরে দারুচিনি গ্র্যান্ডে অবস্থান করছি। প্রতিবাদস্থলে আমি প্রায় পাঁচজনের সঙ্গে ছিলাম। তবে সবাই আলাদা আলাদা। মোবাইল ফোনটা বের করে হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রেকর্ড করতে থাকি। দেখলাম একদল মিলিটারি তেড়ে আসছে আমার দিকে। আমাকে রেকর্ডিং বন্ধ করতে বলে। ফোনটি কেড়ে নেয়। ফোনে থাকা সব ফুটেজ ডিলিট করে দেয়।
গালাগাল করতে থাকে আমাকে। এ সময় আমার এক ছেলেবন্ধু আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে তাকেও অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। তারা তাকে প্রচণ্ড আঘাত করে। কিছু সময়ের জন্য গুম করে ফেলে। আমরা তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমনকি কোনো থানায় ছিল না। তাকে ছাড়ার আগে একটি গলিতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
সেখানে কালো পোশাকে সামরিক লোক ছিল এবং তাদের মুখ ঢেকে রেখেছিল। এ ছাড়াও সেখানে বেশ কয়েকজন বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাও ছিলেন। তাদের আচরণ দেখে মাতাল মনে হচ্ছিল।
কামান্থি বিক্রমাসিংহে : নাইট অব দ্য জার্নালিস্ট পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রীলংকার শীর্ষস্থানীয় অনলাইন ডেইলি মিররের সাংবাদিক