রোহিঙ্গা সংকটের চিত্র জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন-ন্যামের শীর্ষ সম্মেলনে তুলে ধরে এর সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চাইলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়াই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ন্যামের অষ্টাদশ শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে শুক্রবার সকালে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে বান্দুং সম্মেলনে গৃহীত নীতিমালার আলোকে সমকালীন বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্মিলিত ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ নিয়ে আলোচনায় বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সাফল্য থাকা সত্ত্বেও দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
“প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। আর দ্বিতীয়টি হল রোহিঙ্গা সংকট।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট রাজনৈতিক এবং এই সমস্যার মূল মিয়ানমারেই রয়েছে। তাই এর সমাধানও মিয়ানমারের ভেতরেই খুঁজে বের করতে হবে।”
বিপুল সংখ্যক এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে চলমান সংকট বাংলাদেশের বাইরেও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে সতর্ক করেন শেখ হাসিনা।
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অনিশ্চয়তা যে আঞ্চলিক সংকটের মাত্রা পেতে যাচ্ছে, তা বিশ্বকে উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। রোহিঙ্গাদের স্ব-ভূমে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে জাতিসংঘে চারটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি।
সরকারের নানা উদ্যোগের পরেও দুই বছরের বেশি সময়েও রোহিঙ্গা সংকটের সুরাহা না হওয়ায় ন্যাম নেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সমর্থন চাইতে বাধ্য হচ্ছি।”
বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন, যাদের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা এসেছেন ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে নতুন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান হিসেবে বর্ণনা করে আসছে।
১২০টি উন্নয়নশীল দেশের জোট ন্যাম রাজনৈতিক সমন্বয় ও পরামর্শের জন্য জাতিসংঘের পর সবচেয়ে বড় ফোরাম হিসেবে পরিচিত।
স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা ৫৮ বছরের পুরনো এ জোটের দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনে প্রায় ৪০টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের পাশাপাশি পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকা ১৭টি দেশ ও ১০ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন।
ন্যামভুক্ত দেশগুলোতে বসবাস করে বিশ্বের ৫৫ শতাংশ মানুষ। স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে এই জোট কাজ করেছিল, তা পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টি এবারের সম্মেলনে আলোচনায় থাকছে।
শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় ন্যামকে আরও শক্তিশালী করাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাযর সহিংস সংঘাত মোকাবেলায় প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘ দায়বদ্ধ হলেও ন্যাম শান্তি ও সুরক্ষার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে।
যে কোনো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করা প্রতিহত করতে ন্যামের শক্তি ও প্রভাবকে কাজে লাগাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের প্রশ্নটি সাম্প্রতিককালের ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সমস্যা। কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসারায়েলি দখলদার বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারার কারণে ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায়বিচার অধরা রয়ে গেছে।
“অবৈধ দখলদারিত্ব অবশ্যই শেষ হওয়া উচিৎ বলে মনে করে বাংলাদেশ।”
জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাবে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যদিও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায় খুবই ন্যূনতম হলেও এর দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনকে পুরোপুরি মেনে নিতে উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বান্দুং সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি পালনের ওপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ন্যামের নীতিগুলো সাধারণ মানুষের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাগুলোকে প্রতিফলিত করে। তবে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি ওই সব আকাঙ্ক্ষার প্রতি ভয়ানক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।
সমকালীন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো বান্দুং সম্মেলনের অঙ্গীকারগুলোর প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান রাখছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ নানা খাতের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার চিত্রও তুলে ধরেন।
সকালে বাকু কংগ্রেস সেন্টারে ন্যামভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা পৌঁছালে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ তাদের স্বাগত জানান। অতিথিদের নিয়ে ফটোসেশনের পর শুরু হয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন।
শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন ন্যামের বিদায়ী চেয়ারম্যান ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। এরপর বক্তব্য দেন নতুন চেয়ারম্যান ইলহাম আলিয়েভ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের প্রধানদের মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন শেখ হাসিনা।
সম্মেলনের ফাঁকে ইরান ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
সন্ধ্যায় আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের দেওয়া নৈশভোজে যোগ দেন তিনি।